হবে কবে হেলমেটের মান নির্ধারণ ?

হবে কবে হেলমেটের মান নির্ধারণ ?

মোটরসাইকেল চালানোর সময় মাথা নিরাপদ রাখতে হেলমেট অত্যাবশ্যকীয়। এর কোনও বিকল্প নেই। একটা সময় ছিল, বেশিরভাগ মোটরসাইকেল চালক ও আরোহী হেলমেট পরতেন না। তবে ২০১৮ সালের সড়ক পরিবহন আইনের ‘কারাদণ্ড’ ও ‘জরিমানা’ এড়াতে গত দুই-তিন বছর ধরে চিত্র পাল্টে গেছে। চালক ও আরোহীরা এখন হেলমেট পরছেন। কিন্তু হেলমেট পরার হার বাড়লেও কমেনি বাইক দুর্ঘটনায় মৃত্যু ও স্থায়ী পঙ্গুত্ব বরণের হার। এর কারণ হিসেবে দায়ী করা হচ্ছে নিম্নমানের হেলমেটকে।

রাস্তাঘাটে সচরাচর দেখা যায়, মামলার ভয়ে হেলমেট পরেন চালকরা। তবে তা বেশির ভাগই নিম্নমানের। যাত্রীদেরও দেওয়া হয় মানহীন এসব হেলমেট। এতে মামলা থেকে বাঁচলেও অসতর্কতাবশত দুর্ঘটনায় পড়লে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ, ফ্র্যাকচার এমনকি মৃত্যুও ঘটে অহরহ। সংশ্লিষ্টদের মতে, মানহীন হেলমেট যাত্রীদের সুরক্ষার বদলে উল্টো মৃত্যুঝুঁকি বাড়াচ্ছে। বুয়েটের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে— রাজধানীসহ সারা দেশে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ৮৮ শতাংশ মানুষের মৃত্যু হয়েছে হেলমেট না পরার কারণে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে— হেলমেট থাকা সত্ত্বেও দুর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা বাড়ছে। এর একমাত্র কারণ নিম্নমানের হেলমেটের ব্যবহার।

মোটরযান চলাচল আইনের ৪৯-চ ধারায় বলা হয়েছে, চালক ছাড়া মোটরসাইকেলে একজনের বেশি আরোহী বহন করা যাবে না। চালক ও আরোহীকে যথাযথভাবে হেলমেট ব্যবহার করতে হবে। যদি কোনও ব্যক্তি এই বিধান লঙ্ঘন করেন, তাহলে সেটি হবে অপরাধ। এ জন্য তিনি অনধিক তিন মাসের কারাদণ্ড, বা অনধিক ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। চালকের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত হিসেবে দোষসূচক এক পয়েন্ট কাটা যাবে।

এ দিকে যাত্রী সুরক্ষায় হেলমেট ব্যবহারে জোর দেওয়া হলেও এর মান নিয়ে আইনে কিছু উল্লেখ নেই। এ কারণে কেউ মানসম্মত হেলমেট ব্যবহারের তোয়াক্কা করছেন না। মোটরসাইকেল-চালকদের হেলমেটের মান নির্ধারণে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষকে (বিআরটিএ) সরকারের পক্ষ থেকে নির্দেশ দেওয়া হলেও এর কোনও অগ্রগতি নেই। বাস্তবে দেখা যায়, পুরো দেশ মানহীন হেলমেটে সয়লাব। এতে সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। প্রশ্ন হলো, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ক্ষতি কমাতে হেলমেটের মান নির্ধারণ হবে কবে?

সড়কে দায়িত্ব পালনকালে সরাসরি দুর্ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছেন— এমন সব ট্রাফিক পুলিশ সদস্যের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নিম্নমানের হেলমেটের কারণে অনেককে জীবন দিয়ে মাশুল গুণতে হচ্ছে। যেকোনও দুর্ঘটনায় মোটরসাইকেল আরোহী বা চালক যখন ছিটকে রাস্তায় পড়ে যান, তখন তিনি প্রথম আঘাতটি পান মাথায়। এ কারণে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মৃত্যু সবচেয়ে বেশি। হেলমেট না পরলে জরিমানাসহ মামলা করা হয়। ফলে পুলিশের মামলা এড়াতে বেশিরভাগ বাইকার নিম্নমানের হেলমেট ব্যবহার করেন। ট্রাফিক পুলিশ জানায়, মানুষের উচিত, নিজেদের ও পরিবারের সুরক্ষার কথা ভেবে ভালো মানের হেলমেট ব্যবহার করা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাথায় একটি ভালো মানের হেলমেট থাকলে বড় ধরনের আঘাত থেকে বেঁচে যান চালক বা আরোহী। সে ক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় আহত হলেও প্রাণহানির ঝুঁকি থাকে কম। কিন্তু নিম্নমানের হেলমেটগুলো আঘাত পাওয়ামাত্রই ভেঙে দুমড়েমুচড়ে যায়। ভাঙা প্লাস্টিক মাথাসহ শরীরের বিভিন্ন অংশে ঢুকে মারাত্মক আঘাতের সৃষ্টি করে। এতে মৃত্যুঝুঁকি বাড়ে। অনেকে আবার স্থায়ী পঙ্গুত্বের শিকার হন।

রাইড শেয়ারিং কোনও কোম্পানিই ভালো মানের হেলমেট চালকদের সরবরাহ করছে না

হেলমেটের মান নির্ধারণ নিয়ে সাধারণ মানুষের ভাবনা
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, বেশিরভাগ মোটরসাইকেল চালক ও আরোহীর হেলমেট নিম্নমানের। খুব কমসংখ্যকই মানসম্মত হেলমেট ব্যবহার করেন। রাইড শেয়ারিংয়ের বাইক-চালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কোম্পানির পক্ষ থেকে যে হেলমেট দেওয়া হচ্ছে, সেগুলোও নিম্নমানের। এগুলোকে চালকরা বলে থাকেন ‘প্লাস্টিকের বাটি’। রাইড শেয়ারিং কোনও কোম্পানিই ভালো মানের হেলমেট চালকদের সরবরাহ করছে না। মাত্র দুই থেকে পাঁচ শতাংশ চালক ভালো হেলমেট ব্যবহার করছেন, সেটাও নিজ উদ্যোগে।

রাজধানী বাড্ডার সাঁতারকুল এলাকার বাসিন্দা মো. তারেক। রাইড শেয়ার করেই জীবিকা নির্বাহ করেন তিনি। তার ও যাত্রীর ব্যবহার করা হেলমেট দেখে বোঝা যায় যথেষ্ট মানসম্মত। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘আমার মাথার হেলমেটের দাম সাড়ে ছয় হাজার টাকা। যাত্রীর হেলমেটও একই দামের।’

রাজধানীতে রাইড শেয়ার করা তেমন কাউকে সচরাচর এমন দামি হেলমেট ব্যবহার করতে দেখা যায় না। এ কারণে কৌতূহল নিয়ে দামি হেলমেট ব্যবহারের বিষয়ে জানতে চাইলে তারেক বলেন, ‘আমি যেহেতু বাইক চালিয়ে উপার্জন করি, সে ক্ষেত্রে নিজের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করেই আমাকে বাইক চালাতে হবে। প্রথমে আমি কোম্পানির দেওয়া হেলমেট ব্যবহার করতাম। কিন্তু একদিন তা হাত থেকে পড়ে ভেঙে যায়। যে দিন আমার একটা মেয়ে সন্তান হয়েছে, সে দিন মনে হয়েছে— আমার দায়িত্ব আরও বাড়লো। আমাকে আরও সচেতন হতে হবে। আমার মনে হয়েছে, সত্যিকার অর্থেই নিজের নিরাপত্তার জন্য ভালো মানের হেলমেট ব্যবহার করা প্রয়োজন।’

রাজধানীতে নিয়মিত রাইড শেয়ার অ্যাপ ব্যবহারকারীদের একজন মো. ইউনুস মানসম্মত হেলমেট পরেন। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘সরকার জনগণের কল্যাণে ও নিরাপত্তার স্বার্থে হেলমেট ব্যবহারের আইন করেছে। কিন্তু এই আইনের ফলে মোটরসাইকেল আরোহী বা ব্যবহারকারীদের তেমন কোনও লাভ হয়নি। কারণ, এতে হেলমেটের মান নির্ধারণের বিষয়ে কিছুই উল্লেখ করা করা হয়নি। গণমাধ্যমের বরাতে অসংখ্য বার শুনেছি— হেলমেটের মান নির্ধারণ করা হবে। কিন্তু এর কোনও কার্যকারিতা দেখছি না। শিগগিরই এ নিয়ে আইন করে হেলমেটের মান নির্ধারণ করা উচিত।’

নিম্নমানের হেলমেটের বিষয়ে পুলিশের বক্তব্য
নিম্নমানের হেলমেট ব্যবহারের বিষয়ে বরাবরই পুলিশের ভাষ্য হচ্ছে— হেলমেটের মান নিয়ে তারা কাজ করেন না। কোনও মোটরসাইকেল আরোহী বা চালক হেলমেট পরেছেন কিনা, সেটা তারা নিশ্চিত করেন এবং প্রয়োজন অনুযায়ী আইনি পদক্ষেপ নেন। মোটরসাইকেলের চালক বা আরোহী মামলা থেকে বাঁচতে যে নিম্নমানের হেলমেট পরেন, তা জেনেও সুনির্দিষ্ট নীতিমালা না থাকায় পুলিশ এ ক্ষেত্রে কিছুই করতে পারে না।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) উপ-কমিশনার (ডিসি) ওয়ালিদ হোসেন বলেন, ‘মোটরসাইকেল চালক বা আরোহী হেলমেট পরেছেন কিনা, সেটি আমরা নিশ্চিত করি। কিন্তু এটার মান কেমন, সেটা দেখি না। কারণ এর মানের বিষয়ে আইনে সুনির্দিষ্ট কিছু উল্লেখ নেই।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে হেলমেটের মান নির্ণয়ের তেমন কোনও ব্যবস্থা নেই। তবে মান নির্ধারণ করা উচিত।’

পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ বলছে, বেপরোয়া মোটরসাইকেলের গতি ও নিম্নমানের হেলমেটের কারণে বেশিরভাগ দুর্ঘটনা ঘটে। মোটরসাইকেল চালকদের সচেতন হাওয়াসহ শিগগিরই হেলমেটের মান নির্ধারণ করা হবে বলে প্রত্যাশা পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের।

নুর মোহাম্মদ নামে ডিএমপির এক সার্জেন্ট বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মোটরসাইকেলে যাত্রা করতে হলে চালক ও যাত্রীর মাথায় হেলমেট থাকা বাধ্যতামূলক। তবে মানসম্মত হেলমেট পরলে চালক ও আরোহী অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে দুর্ঘটনার শিকার হলেও সুরক্ষা বজায় থাকতো।’

মানসম্মত হেলমেট চেনার উপায়
দাম ও মান অনুযায়ী, বর্তমানে বাজারে ৩০০ টাকা থেকে শুরু করে ১০ হাজার টাকা দামের হেলমেটও পাওয়া যায়। এর মধ্যে কিছু আছে, যেগুলো আন্তর্জাতিক মাপকাঠি মেনে তৈরি। হেলমেটে আইএসও লোগো রয়েছে কিনা কেনার আগে তা যাচাই করা জরুরি। কারণ এ ধরনের হেলমেট নির্দিষ্ট প্রটোকল মেনে তৈরি করা হয়। বর্তমানে বেশিরভাগ হেলমেট ফাইবার গ্লাস দিয়ে তৈরি। তবে কেউ বেশি সুরক্ষা চাইলে কার্বন-কেভলার মিশ্রিত মেটেরিয়াল দিয়ে তৈরি হেলমেট কিনতে পারেন। হেলমেট কেনার সময় হেলমেটটি ডট সার্টিফায়েড কিনা তা দেখে কিনতে হবে। কারণ ডট সার্টিফায়েড হেলমেটের সুরক্ষায় ব্যবস্থা ভালো থাকে।

হেলমেট বাছাইয়ের ক্ষেত্রে তরুণ চালকরা নিরাপত্তার পাশাপাশি খোঁজেন স্মার্ট নকশা এবং ওজনে হালকা হেলমেট। রাজধানীর বংশাল, বাংলামোটর, ষাট ফিট, মিরপুর ১০, উত্তরাসহ বিভিন্ন মোটরবাইকের পার্টসের মার্কেটে ও নামিদামি মোটরবাইকের দোকানে মানসম্মত হেলমেট পাওয়া যায়। দেশের বাজারে হেলমেট উৎপাদনের উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠান না থাকার কারণে পুরোটাই আমদানিনির্ভর। ফ্রান্স, ইউরোপ, চীন ও ভারত থেকে আমদানিকারকেরা প্রায় ২০টি ব্র্যান্ডের হেলমেট দেশে বাজারজাত করেন। ইয়োহি, এক্সোর, এক্সিস, এইরোহ, টর্ক, এলএসটু, স্টিলবার্ড, ভেগা, এইচজেসি, সিএসবি, এমটি, শার্ক, এসএমকে, স্টুডস, অ্যারোস্টারসহ বেশ কয়েকটি ব্র্যান্ডের হেলমেট দেশের বাজারে পাওয়া যায়।