যেভাবে ঈদ করতেন রাসুল (সা.) ও সাহাবিরা

যেভাবে ঈদ করতেন রাসুল (সা.) ও সাহাবিরা

ঈদ মানে আনন্দ, ঈদ মানে খুশি। আর এ ঈদ হলো মুসলিমদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব। ঈদ বছরে দুবার আসে। আরবি শব্দ ‘ঈদ’-এর অর্থ ফিরে আসা। যেহেতু প্রতিবছরই এটা ফিরে আসে তাই, একে ঈদ বলা হয়। পুরো এক মাস রমজানের সংযম শেষে পালিত হয় ঈদুল ফিতর। আবার জিলহজ মাসের দশম দিনে পালিত হয় ঈদুল আজহা।

এখন কথা হলো ঈদ উদযাপন কি দামি পোশাক, রঙিন জামা-জুতা, সুস্বাদু খাবার আর নানা ধরনের আনন্দ-উৎসবের নাম? নাকি শুধু ঈদের নামাজেই ধনী-গরিবকে এক কাতারে দাঁড় করানো? না, আসলে তা নয়। মূলতা তাদের মধ্যে বৈষম্য দূর করা ঈদের অন্যতম উদ্দেশ্য। ঈদের উদ্দেশ্য কী তা আল্লাহ তা’আলা নিম্নোক্ত আয়াতের মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন-

‘আর যেন তোমরা নির্ধারিত সংখ্যা পূরণ করতে পারো এবং তোমাদের যে সুপথ দেখিয়েছেন, তার জন্যে তোমরা আল্লাহর মমত্ব-বড়ত্ব প্রকাশ করো এবং তার কৃতজ্ঞ হও।’ (সূরা বাকারা-১৮৫)। এই আয়াত থেকে প্রমাণিত হচ্ছে ঈদের উদ্দেশ্য হলো দুটি-

১) আল্লাহর বড়ত্ব, মহত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করা।

২) আল্লাহ যে নেয়ামত দান করেছেন তার জন্য আল্লাহর কৃতজ্ঞতা আদায় করা। 

ঈদে আমাদের যা করণীয় :

মহানবী হজরত মুহাম্মদ (স.) এবং সাহাবারা তাদের জীবনে দেখিয়েছেন এ উৎসবের তাৎপর্য। কীভাবে তারা ঈদ পালন করতেন এবং কীভাবে ঈদের দিন সময় কাটাতেন সেদিকে তাকালেই তা পরিষ্কার হয়ে যায়।

নবীজি (স.) ঈদের দিনে বের হয়ে দুই রাকাত ঈদের সালাত আদায় করেছেন। [সহীহ বুখারি : ৯৮৯]

ঈদের দিন গোসলের মাধ্যমে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অর্জন করাকেও নবীজি (স.) গুরুত্ব দিয়েছেন। হযরত ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসূল (স.) ঈদুল ফিতরের দিনে ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে গোসল করতেন।’ [সুনানে বায়হাকী : ৫৯২০]

হযরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘সুন্নাত হলো ঈদগাহে হেঁটে যাওয়া।’ [সুনানে আত-তিরমিযী : ৫৩৩] উভয় পথের লোকদের সালাম দেওয়া ও ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করার জন্য যে পথে যাবে সে পথে না ফিরে অন্য পথে ফিরে আসা।

হাদিসে এসেছে, ‘নবী (সা.) ঈদের দিনে পথ বিপরীত করতেন।’ [সহিহ বুখারি : ৯৮৬]

ঈদুল ফিতরের দিনে ঈদের সালাত আদায়ের পূর্বে খাবার গ্রহণ করা উত্তম। হযরত বুরাইদা (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘নবী (সা.) ঈদুল ফিতরের দিনে না খেয়ে বের হতেন না।’

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ রাববুল আলামিন তার বান্দার ওপর তার প্রদত্ত নিয়ামতের প্রকাশ দেখতে পছন্দ করেন।’ [সহীহ আলজামে : ১৮৮৭]।

ইবনুল কায়্যিম (র.) বলেছেন, ‘নবী (সা.) দুই ঈদেই ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে সর্বোত্তম পোশাক পরিধান করতেন।’ [যাদুল মায়াদ]

আবদল্লাহ বিন সায়েব (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘আমি নবী (সা.) -এর সঙ্গে ঈদ উদযাপন করলাম। যখন তিনি ঈদের সালাত শেষ করলেন, বললেন- আমরা এখন খুতবা দেবো। যার ভালো লাগে সে যেন বসে, আর যে চলে যেতে চায় সে যেতে পারে।’ [সুনান আবু দাউদ : ১১৫৭]

ঈদের সময় বিভিন্ন আত্মীয়-স্বজনের খোঁজ-খবর নেওয়া ও তাদের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার বিশেষ সুযোগ তৈরি হয়। এ সম্পর্কে রাসুলুল্লাহু (স.) বলেছেন, ‘যে আখেরাতে বিশ্বাস করে, সে যেন আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখে।’ [সহিহ বুখারি : ৬১৩৮]

জীবন চলার পথে বিভিন্ন পর্যায়ে কারও কারও সম্পর্কের অবনতি হতে পারে। ঈদের সময় পারস্পরিক মনোমালিন্য দূর করা ও সম্পর্ক সুদৃঢ় করার উত্তম সময়। হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কোনো মুসলিমের জন্য বৈধ নয় যে, তার ভাইকে তিন দিনের বেশি সময় সম্পর্ক ছিন্ন রাখবে। তাদের অবস্থা এমন যে দেখা সাক্ষাৎ হলে একজন অন্য জনকে এড়িয়ে চলে। এ দুজনের মাঝে ওই ব্যক্তি শ্রেষ্ঠ যে প্রথম সালাম দেয়।’ [সহিহ মুসলিম : ৬৬৯৭]

উম্মুল মুমিনীন হজরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, ‘রাসূলুল্লাহ (সা.) ঈদের দিন আমার ঘরে আগমন করলেন, তখন আমার নিকট দুটি ছোট মেয়ে গান গাইতেছিল, বুয়াস যুদ্ধের বীরদের স্মরণে। তারা পেশাদার গায়িকা ছিল না। ইতোমধ্যে আবু বকর (রা.) ঘরে প্রবেশ করে এই বলে আমাকে ধমকাতে লাগলেন যে, নবীজির ঘরে শয়তানের বাঁশি? রাসুলুল্লাহ (সা.) তার কথা শুনে বললেন, ‘মেয়ে দুটিকে গাইতে দাও হে আবু বকর! প্রত্যেক জাতির ঈদ আছে, আর এটি আমাদের ঈদের দিন।’ [সহিহ বুখারি : ৯৫২]

রমজান মাসে সিয়ামের ত্রুটি-বিচ্যুতি পূরণার্থে এবং অভাবগ্রস্তদের খাবার প্রদানের উদ্দেশ্যে ঈদের সালাতের পূর্বে নির্ধারিত পরিমাণের যে খাদ্য সামগ্রী দান করা হয়ে থাকে শরিয়তের পরিভাষায় তাকেই জাকাতুল ফিতর বা ফিতরা বলা হয়। হাদিসে বর্ণিত, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ঈদের নামাজে যাওয়ার পূর্বে ফিতরা আদায় করার আদেশ দিয়েছেন। [সহিহ বোখারি: ১৫০৩]

আব্দুল্লাহ ইবনে উমার রা. হতে বর্ণিত, রাসূল (সা.) ঈদুল ফিতরের দিন ঘর থেকে বের হয়ে ঈদগাহে পৌঁছা পর্যন্ত ‘আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার, ওয়া লিল্লাহিল হামদ।’ তাকবীর পাঠ করতেন। [মুসতাদরাক : ১১০৬]

আব্দুল্লাহ বিন সায়েব (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূল (সা.) এর সঙ্গে ঈদ উদযাপন করলাম। যখন তিনি ঈদের নামাজ শেষ করলেন, তখন বললেন, ‘যার ভালো লাগে সে যেন বসে, আর যে চলে যেতে চায় সে যেতে পারে’। [সুনানে আবু দাউদ : ১১৫৭]

ঈদের নামাজের পর রাসূল (সা.) তার সাহাবীদের সঙ্গে মুসাহাফাহ ও মুআনাকাহ করতেন।

ঈদে পরস্পরকে শুভেচ্ছা জানানো শরিয়ত অনুমোদিত একটি বিষয়। বিভিন্ন বাক্য দ্বারা এ শুভেচ্ছা বিনিময় করা যায়। যেমন-

এক. হাফেয ইবনে হাজার (র.) বলেছেন, সাহাবারা ঈদের দিন সাক্ষাৎকালে একে অপরকে বলতেন, ‘তাকাববালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকুম’ অর্থ- আল্লাহ-তায়ালা আমাদের ও আপনার ভালো কাজগুলো কবুল করুন।

দুই. ‘ঈদ মোবারক’ ইনশাআল্লাহ।

তিন. ‘ঈদুকুম সাঈদ’ বলে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করা যায়।

ঈদের সময় বিভিন্ন আত্মীয়-স্বজনের খোঁজ-খবর নেওয়া ও তাদের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার বিশেষ সুযোগ তৈরি হয়। প্রতিবেশীরও খোঁজ-খবর নেওয়া ঈদের সময় প্রতিবেশীর হক আদায়ের সুযোগ তৈরি হয়।

জীবন চলার পথে বিভিন্ন পর্যায়ে কারও কারও সম্পর্কের অবনতি হতে পারে। ঈদের সময় পারস্পরিক মন-মালিন্য দূর করা ও সম্পর্ক সুদৃঢ় করার উত্তম সময়।

ঈদে আমাদের যা বর্জনীয় :

ঈদ মুসলিম জাতির গুরুত্বপূর্ণ উৎসব। আর আমাদের রয়েছে নিজস্ব সংস্কৃতি। আমরা ঈদ পালনে অনেকে ইসলাম সমর্থন করে না এমন সব সংস্কৃতিতে নিমজ্জিত হচ্ছি। যা আমাদের বর্জন করা দরকার। ঈদে বর্জনীয় বিষয়গুলো হলো-

ঈদের দিন রোজা পালন করলে ঈদের দিনের কাজসমূহ যথাযথ পালন করা যাবে না। সেজন্য হাদিসে ঈদের দিন রোজা পালন করা থেকে বিরত থাকার নির্দেশ এসেছে। সহিহ বোখারি ও মুসলিমে বর্ণিত আছে, ‘হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার দিনে রোজা রাখতে নিষেধ করেছেন।’ [সহিহ মুসলিম : ২৭৩০]

বিজাতীয় আচরণ মুসলিম সমাজে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। পোশাক-পরিচ্ছদে, চাল-চলনে, শুভেচ্ছা বিনিময়ে অমুসলিমদের অনুকরণে লিপ্ত হয়ে পড়েছে মুসলমানদের অনেকেই। ঈদের দিনে এ কাজটি অন্যান্য দিনের চেয়ে বেশি পরিলক্ষিত হয়। এটা করা যাবে না। সেই সঙ্গে গান-বাজনা করা, অশ্লীল সিনেমা ও নাটক দেখা- যা ইসলাম অনুমোদন করে না, তা থেকে বিরত থাকতে হবে।

অনেকে বেহুদা কাজে ঈদে রাত জাগরণ ও দিনে বেহুদা কাজে সময় নষ্ট করে থাকে। সেজন্য বেহুদা কাজে সময় নষ্ট করা থেকে বিরত থাকা দরকার। কোরআনে মুমিনের গুণাবলি সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘আর যারা অনর্থক কথা-কর্ম থেকে বিমুখ থাকে। [সূরা মুমিনুন : ০৩]

ঈদের আনন্দে অনেকে এমনভাবে উদাসীন থাকেন যে, ফরজ নামাজ আদায়ে অলসতা করেন, যা গ্রহণযোগ্য নয়। কোরআনে বলা হয়েছে, অতএব সেই নামাজ আদায়কারীদের জন্য দুর্ভোগ, যারা নিজেদের নামাজে অমনোযোগী। [সূরা মাউন : ৪-৫]

ঈদের কেনাকাটা থেকে শুরু করে এ উপলক্ষে সব কিছুতেই অপচয় ও অপব্যয় করা হয়। অথচ কোরআনে বলা হয়েছে, আর তোমরা কোনোভাবেই অপব্যয় করো না, নিশ্চয়ই অপব্যয়কারী শয়তানের ভাই। (সূরা বনি ইসরাঈল : ২৬-২৭)

অনেকে এ দিনকে কবর জিয়ারতের জন্য নির্দিষ্ট করে থাকেন, যা রাসূলুল্লাহ (সা.) ও সাহাবায়ে কেরাম থেকে সাব্যস্ত হয়নি। অতএব ঈদের দিনকে কবর জিয়ারতের জন্য নির্দিষ্ট করা যাবে না। এজন্য রাসূল (সা.) বলেছেন, যে এমন ইবাদত করল যাতে আমাদের কোনো নির্দেশনা নেই তা পরিত্যাজ্য হিসেবে গণ্য হবে। (সহিহ মুসলিম : ৪৫৯০)

এগুলো শরিয়তবিরোধী কাজ। আল্লাহ-তায়ালা বলেন, হে মুমিনগণ, নিশ্চয়ই মদ, জুয়া, প্রতিমা-বেদী ও ভাগ্য-নির্ধারক তীরসমূহ তো নাপাক শয়তানের কর্ম। সুতরাং তোমরা তা পরিহার কর, যাতে তোমরা সফলকাম হও। [সূরা মায়িদা : ৯০]

ঈদের দিনে অনেকে এমন কাজ করেন যা মানুষকে কষ্ট দেয়। যেমন, রাস্তা আটকিয়ে মানুষের কাছ থেকে টাকা নেওয়া, এমন আনন্দ করা যাতে অন্যরা কষ্ট পায়। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, মুসলিম ওই ব্যক্তি যার হাত ও জিহ্বা থেকে অন্যরা নিরাপদ। [সহিহ বোখারি : ৬৪৮৪]

অনেকে ঈদের আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে নতুন জামা-কাপড় পরিধান, সেমাই, ফিরনি ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন, ঈদের নামাজ আদায় করার কথা ভুলে যান। অথচ এই দিনে ঈদের নামাজ আদায় করা হচ্ছে মূল করণীয়।

ঈদ একটি ইবাদত, আনন্দের মাঝেও যে ইবাদত পালন করা যায়, ঈদ তার অন্যতম উদাহরণ। শরিয়াহ সম্মতভাবে আনন্দ প্রকাশ করার বিষয়ে কোরআনে এসেছে, বলো, এটা আল্লাহর অনুগ্রহ ও রহমত, সুতরাং এ নিয়েই যেন তারা খুশি হয়। এটি যা তারা জমা করে তা থেকে উত্তম। [সূরা ইউনুস : ৫৮]।