নৌযানের সংখ্যা কত জানে না কেউ

নৌযানের সংখ্যা কত জানে না কেউ

সারা দেশে অনিবন্ধিত কত সংখ্যক নৌযান চলছে- এমন কোনো পরিসংখ্যান নেই সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর কাছে। শুধু তাই নয়, কোন অঞ্চলের নদ-নদীতে কি ধরনের যাত্রী বা পণ্যবাহী নৌযান চলাচল করছে, এরও কোনো তথ্য ভাণ্ডার নেই। অবৈধ এসব নৌযান চলায় একদিকে সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে, অপরদিকে বাড়ছে নৌ খাতে বিশৃঙ্খলা। সেইসঙ্গে বাড়ছে দুর্ঘটনাও। এত কিছুর পরও নির্বিকার কর্তৃপক্ষ। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।

এসব নৌযানের সার্বিক কার্যক্রম দেখভালের দায়িত্ব সরকারের দুই সংস্থা- নৌ মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহণ কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) ও নৌ পরিবহণ অধিদপ্তর। সংস্থা দুটির ঊর্ধ্বতন কয়েক কর্মকর্তাদের মতে, সারা দেশে নিবন্ধিত যে সংখ্যক (ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৩ হাজার ৪৮৬টি) নৌযান রয়েছে, তার বেশি রয়েছে অনিবন্ধিত নৌযান। নৌযান মালিক ও শ্রমিক নেতাদের মতে, সারা দেশে অনিবন্ধিত বালুবাহী (বাল্কহেড) জাহাজ, ট্রলার ও স্পিডবোট মিলিয়ে অন্তত ২০ হাজার নৌযান চলছে। আইনগতভাবে নিবন্ধনহীন ১৬ হর্স শক্তির বেশি ইঞ্জিনচালিত নৌযান চলাচল অবৈধ ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

নৌ খাতের মালিক ও শ্রমিক নেতারা জানান, শুধু উল্লিখিত দুই সংস্থা নয়, নৌ পুলিশ, কোস্টগার্ড ও স্থানীয় প্রশাসনকে ‘ম্যানেজ’ করেই প্রভাবশালীদের মাধ্যমে চলছে অবৈধ এসব নৌযান। এরা এতই প্রভাবশালী যে, তাদের কাছে যারা নিয়ম মেনে নৌযান পরিচালনা করছেন তারা অনেক সময় অসহায় হয়ে পড়ছেন।

নিবন্ধনহীন অবৈধ এসব নৌযান চলাচল করার সুযোগ দেয়ার জন্য পরস্পরকে দুষছেন দুই সংস্থার কর্মকর্তারা। একপক্ষের মতে, মাওয়া (শিমুলিয়া), বাংলাবাজার (মাদারীপুরের কাঁঠালবাড়ী), পাটুরিয়া, দৌলতদিয়াসহ বিভিন্ন স্থানে বিআইডব্লিউটিএর ঘাট ব্যবহার করে চলাচল করছে অসংখ্য অনিবন্ধিত নৌযান। ওইসব ঘাট ইজারা দিয়েও রাজস্ব আদায় করছে সংস্থাটি। এসব ঘাট থেকে অনিবন্ধিত নৌযান চলাচল বন্ধ করতে বিআইডব্লিউটিএকে চিঠি দিয়েছে নৌ পরিবহণ অধিদপ্তর। অপরপক্ষের মতে, সব নৌযান নিবন্ধন ও ফিটনেস সনদের আওতায় আনতে না পারা নৌ পরিবহণ অধিদপ্তরের ব্যর্থতা। দেশে কত সংখ্যক বৈধ-অবৈধ নৌযান চলাচল করছে সেই সংখ্যা বের করতে ২০১৬ সালে নৌযান শুমারির উদ্যোগ নেয়া হলেও এ সংস্থার সেই প্রকল্পটি এখনও আলোর মুখ দেখেনি।

গত ৪০ বছর ধরে নৌযান ব্যবসা করছেন সংসদ সদস্য গোলাম কিবরিয়া টিপু। অবৈধ নৌযান নিয়ে তার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, দেশ ধাপিয়ে বেড়াচ্ছে নিবন্ধনহীন বাল্কহেড। এদের রাতে চলাচল নিষিদ্ধ। তবুও তারা দিনে-রাতে সমানভাবে চলাচল করছে। এসব নৌযানের পর্যাপ্ত নিরাপত্তা বাতি নেই। বালি পরিপূর্ণ অবস্থায় এসব নৌযানের শুধু সামনের কিছু অংশ ও পেছনের অংশ পানির উপরে থাকে। কোনো কারণে বাল্কহেডের সঙ্গে ধাক্কা লাগলে তা ডুবে গিয়ে শত শত মানুষের প্রাণহানির শঙ্কা নিয়ে লঞ্চ চালাতে হয়। তিনি বলেন, প্রশাসন ও প্রভাবশালীদের ম্যানেজ করে চলা এসব বাল্কহেডের বিরুদ্ধে কিছু বললেই লঞ্চ মালিকদের হেনস্তা করে, সালিশের নামে লঞ্চ মালিকদের কাছে চাঁদা আদায় করে। তার মতে, সারা দেশে ১৫ থেকে ২০ হাজার নিবন্ধনহীন বাল্কহেড চলাচল করছে।

নৌ পরিবহণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ১৯৯১ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত দেশে ৬০২টি দুর্ঘটনায় ৩ হাজার ৭৩৫ জন মারা গেছেন। এসব ঘটনায় আহত হয়েছেন ৫২৬ জন ও নিখোঁজ হয়েছেন ৫০১ জন। চলতি বছরেই বড় দুটি নৌ দুর্ঘটনায় সারা দেশে আলোচনায় আসে। একটি হচ্ছে নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীতে এসকে-৬ নামের একটি মালবাহী জাহাজের ধাক্কায় এমএল সাবিত আল হাসান ডুবে ৩৫ জনের মৃত্যু হয়। সর্বশেষ মাওয়ায় স্পিডবোট দুর্ঘটনায় ২৬ জনের প্রাণহানি ঘটে। ওই স্পিডবোটটিও নিবন্ধন ছাড়াই চলছিল। জানা গেছে, ২০১৭ সালে কুয়াকাটা যাওয়ার সময়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী থাকা অবস্থায় তারানা হালিম নৌ দুর্ঘটনার শিকার হন। তাকে বহনকারী এমভি আওলাদ লঞ্চটি রাতে চলাচলকারী নিবন্ধনহীন একটি কার্গোর সঙ্গে ধাক্কা লাগে। এতে কার্গো জাহাজটি ডুবে যায়। অল্পতে বেঁচে যান লঞ্চের যাত্রী তারানা হালিমের সফরসঙ্গী ও সাংবাদিকরা।

নিয়ম অনুযায়ী, নৌযানের নকশা নৌ পরিবহণ অধিদপ্তর থেকে অনুমোদনের পর সেই নকশা অনুযায়ী নৌযান নির্মাণ করতে হবে। নির্মিত নৌযান পরিদর্শন করে রেজিস্ট্রেশন ও ফিটনেস সনদ দেন সার্ভেয়াররা। ওই সনদ দুটি দেখিয়ে বিআইডব্লিটিএ থেকে রুট পারমিট নিতে হয়। এরপরই নৌযানটি চলাচলের জন্য উপযুক্ত হয়। বর্তমানে বিআইডব্লিউটিএ শুধু যাত্রীবাহী ৭৮০টি নৌযানের রুট পারমিট দিয়েছে। তবে ফি অনুমোদন না পাওয়ায় পণ্যবাহী নৌযানের রুট পারমিট দেয়া শুরু করেনি।

বর্তমানে কত সংখ্যক নিবন্ধনহীন নৌযান চলাচল করছে- এ বিষয়ে জানতে চাইলে নৌ পরিবহণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কমডোর আবু জাফর মো. জালাল উদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, যতগুলো বৈধ নৌযান রয়েছে সেগুলোর পরিসংখ্যান আমাদের কাছে আছে। এর বাইরে যেগুলো চলে সেগুলোর জন্য একটি প্রকল্প প্রস্তাব নিয়ে কাজ চলছে। সব নৌযান নিবন্ধনের আওতায় আনতে সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, যারা ট্যাক্স, ভ্যাট দেয়াসহ সব নিয়ম মেনে নৌযান পরিচালনা করছেন তারা যেসব সুবিধা পাচ্ছেন, যারা নিয়ম মানছেন না তারাও একই সুবিধা ভোগ করছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিয়ম ভঙ্গকারীরা বেশি সুবিধা পাচ্ছেন। তাহলে কেন তারা নিবন্ধনের আওতায় আসবেন।

নৌ পরিবহণ অধিদপ্তরের একাধিক সার্ভেয়ার ও ইন্সপেক্টর জানান, অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল অধ্যাদেশের ৮১ ধারা অনুযায়ী বিআইডব্লিউটিএর ৪৭ জন কর্মকর্তাকে অনিবন্ধিত ও ফিটনেসবিহীন নৌযানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার আইনগত ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। কিন্তু তারা খুব কমই ওই আইনের প্রয়োগ করেন। অনেক ক্ষেত্রে নিবন্ধনহীন জাহাজ থেকে কনজারভেন্সি চার্জ আদায়ের মাধ্যমে তাদের বৈধতা দেন কোনো কোনো কর্মকর্তা। খুলনা, কক্সবাজার, সুনামগঞ্জ, রাঙামাটি, ভৈরবসহ কয়েকটি এলাকায় এভাবে কনজারভেন্সি চার্জ নেয়ার রসিদ আমরা পেয়েছি। তারা আরও জানান, বিআইডব্লিউটিএ ও বিআইডব্লিউটিসির অনেক জাহাজের নিবন্ধন নেই।

বন্দর ব্যবহার করে অনিবন্ধিত নৌযান চলাচল প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান কমডোর গোলাম সাদেক যুগান্তরকে বলেন, যেমন ধরুন মাওয়া ও পাটুরিয়ায় নিবন্ধিনহীন স্পিডবোট চলাচল করে। এগুলোতে প্রচুরসংখ্যক যাত্রী পরিবহণ করা হচ্ছে। এসব যান জনপ্রিয়তা পেয়েছে। বিকল্প যানবাহন ছাড়া এসব স্পিডবোট বন্ধ করা হলে যাত্রী পারাপার কীভাবে হবেন। তিনি বলেন, স্থানীয় প্রশাসনকে সঙ্গে আইন প্রয়োগ করে হলেও এসব স্পিডবোট নিবন্ধনের আওতায় আনতে হবে। সেগুলোতে দক্ষ চালকের ব্যবস্থা করতে হবে। সব সংস্থা মিলে কাজ করলে এটা কঠিন কাজ নয়। এক প্রশ্নের উত্তরে কমডোর গোলাম সাদেক বলেন, সারা দেশে কী সংখ্যক নিবন্ধনহীন নৌযান রয়েছে তার পরিসংখ্যান নেই। আমরা বন্দর কর্মকর্তাদের একটি পরিসংখ্যান তৈরি করতে বলেছি। তবে আনুমানিক ১০ থেকে ১৫ হাজার নৌযান নিবন্ধন ছাড়াই চলছে- সেটা বলা যায়।

নৌ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশে নিবন্ধিত নৌযান রয়েছে ১৩ হাজার ৪৮৬টি। এর মধ্যে যাত্রীবাহী লঞ্চ ৮৩৮টি, যাত্রীবাহী বোট ৪১৭টি, স্পিডবোট ৩৪০টি, মালবাহী জাহাজ ৩ হাজার ৩৬৭টি, বালিবাহী ৫ হাজার ৭১টি, ড্রেজার ১ হাজার ৩৫২টি। এর বাইরে কতটি নৌযান নিবন্ধন ছাড়াই চলাচল করছে তা নিরূপণে ২০১৬ সালে ন্যাশনাল শিপস অ্যান্ড মেকানাইজড বোটস ডাটাবেজ ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ক্যাপাসিটি বিল্ডিং নামের একটি প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) তৈরি করেছিল নৌ পরিবহণ অধিদপ্তর। ওই সময়ে ৪৪ কোটি ৪৩ লাখ টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে ৩ বছরে সারা দেশের নৌযানের ডাটাবেজ তৈরির কথা ছিল। ওই ডিপিপি এখনও চূড়ান্ত করতে পারেনি সংস্থাটি। ফলে নিবন্ধনহীন নৌযানের সঠিক কোনো পরিসংখ্যান তৈরি করতে পারেনি।

বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক চৌধুরী আশিকুল আলম বলেন, নিবন্ধনহীন নৌযান চলাচলের সুযোগে নৌপথে চাঁদাবাজিও বেড়েছে। প্রতিটি রুটেই বিভিন্ন ধরনের চাঁদাবাজি হচ্ছে। রুটভিত্তিক হিসাব করলে সর্বনিম্ন ৫০০ টাকা ও সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত বিভিন্ন পয়েন্টে চাঁদা দিতে হচ্ছে। এ চাঁদা দিলেই নিবন্ধিত হোক আর অনিবন্ধিত হোক সব জাহাজই চলতে পারছে। আর চাঁদা না দিলে শ্রমিকদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ইজারার নামে, বিভিন্ন সংস্থা ও সংগঠনের নামে এমনকি পুলিশের নামে এসব চাঁদাবাজি হচ্ছে। বারবার অভিযোগ করেও চাঁদাবাজি বন্ধ হচ্ছে না। তার মতে, চাঁদা দিয়ে চলতে পারলে মালিক কেন জাহাজ নিবন্ধন করবেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নৌ পুলিশের ডিআইজি মো. আতিকুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, কোনো পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ প্রমাণিত হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। অনিবন্ধিত নৌযান চলাচলও আমরা বন্ধ করে দিব।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *