হাইকোর্টের শুনানি শেষ থেকে শুরু : ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলা

ভয়াল ‘একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা’র ঘটনা ঘটেছিল ২০০৪ সালে। ওই ঘটনায় করা মামলায় ২০১৮ সালে রায় দেন বিচারিক আদালত। এরপর ২০২২ সালের শেষ দিকে হাইকোর্টে মামলাটির শুনানি শুরু হয়। চলতি বছরেই মামলাটির শুনানি শেষ করার প্রচেষ্টার কথা জানিয়েছিল রাষ্ট্রপক্ষ। তবে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আদালতেও পরিবর্তন আসায় নতুন করে শুরু হচ্ছে মামলাটির শুনানি।

মামলার বিবরণী থেকে জানা গেছে, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলাটি চালানো হয়। অল্পের জন্য ওই হামলা থেকে প্রাণে বেঁচে যান আওয়ামী লীগ সভাপতি ও তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা। তবে হামলায় আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক, সাবেক রাষ্ট্রপতি (প্রয়াত) জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভী রহমানসহ ২৪ জন নিহত হন। আহত হন দলের তিন শতাধিক নেতাকর্মী। ঘটনার পরদিন মতিঝিল থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) ফারুক আহমেদ বাদী হয়ে মামলা করেন।

এদিকে তদন্ত শেষে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২০০৮ সালের ১১ জুন দেওয়া অভিযোগপত্রে বিএনপি নেতা আবদুস সালাম পিন্টু, তার ভাই মাওলানা তাজউদ্দিন ও হুজি নেতা মুফতি আব্দুল হান্নানসহ ২২ জনকে আসামি করা হয়। তখন জানা যায়, শেখ হাসিনাকে হত্যা করতেই এই হামলার ছক করা হয়েছিল। পাকিস্তান থেকে এসেছিল হামলায় ব্যবহৃত আর্জেস গ্রেনেড।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের পর অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেন আদালত। দুই বছর তদন্তের পর ২০১১ সালের ৩ জুলাই ৩০ জনকে আসামি করে সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। এর ফলে এ মামলায় মোট আসামির সংখ্যা হয় ৫২।

মোট ৫২ আসামির মধ্যে আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ এবং মুফতি হান্নান ও তার সহযোগী শাহেদুল ইসলাম বিপুলের মৃত্যুদণ্ড অন্য মামলায় কার্যকর হয়। তিন জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ায় এ মামলার আসামির সংখ্যা দাঁড়ায় ৪৯-এ। এই ৪৯ জনের মধ্যে রায় দেওয়ার সময় ৩১ জন কারাগারে ছিলেন। আর পলাতক ছিলেন বাকি ১৮ জন। তারা হলেন— তারেক রহমান, হারিছ চৌধুরী, কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ, এটিএম আমিন, সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দার, খান সাঈদ হাসান, ওবায়দুর রহমান, মুফতি শফিকুর রহমান, মুফতি আবদুল হাই, রাতুল বাবু, মোহাম্মদ হানিফ, আবদুল মালেক, শওকত ওসমান, মাওলানা তাজউদ্দিন, ইকবাল হোসেন, মাওলানা আবু বকর, খলিলুর রহমান ও জাহাঙ্গীর আলম।

মামলাটির বিচার শেষে ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর বিচারিক আদালত সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ও বিএনপি নেতা আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ড দেন। একইসঙ্গে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান (বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান) তারেক রহমানসহ ১৯ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। এছাড়াও বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয় অপর ১১ আসামিকে।

বিচারিক আদালতের রায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন— লুৎফুজ্জামান বাবর, আব্দুস সালাম পিন্টু, তার ভাই মাওলানা তাজউদ্দিন, হুজির সাবেক আমির ও ইসলামিক ডেমোক্রেটিক পার্টির আহ্বায়ক মাওলানা শেখ আবদুস সালাম, কাশ্মীরি জঙ্গি আব্দুল মাজেদ ভাট, আবদুল মালেক ওরফে গোলাম মোস্তফা, মাওলানা শওকত ওসমান, মহিবুল্লাহ ওরফে মফিজুর রহমান, মাওলানা আবু সাঈদ ওরফে ডা. জাফর, আবুল কালাম আজাদ ওরফে বুলবুল, মো. জাহাঙ্গীর আলম, হাফেজ মাওলানা আবু তাহের, হোসাইন আহম্মেদ তামিম, মঈন উদ্দিন শেখ ওরফে মুফতি মঈন, মো. রফিকুল ইসলাম, মো. উজ্জল, এনএসআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুর রহিম, হানিফ পরিবহনের মালিক বিএনপি নেতা মোহাম্মদ হানিফ। পরিকল্পনা ও অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে হত্যা করার অভিযোগে দণ্ডবিধির ৩০২/১২০খ/৩৪ ধারায় দোষী সাব্যস্ত করে তাদের মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত ফাঁসিতে ঝুলিয়ে রাখার নির্দেশ দেওয়ার পাশাপাশি প্রত্যেককে ১ লাখ টাকা করে জরিমানা করেন আদালত।

যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন— বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, খালেদা জিয়ার সাবেক রাজনৈতিক উপদেষ্টা হারিছ চৌধুরী, বিএনপি নেতা কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ, হুজি সদস্য হাফেজ মাওলানা ইয়াহিয়া, শাহাদাৎ উল্লাহ ওরফে জুয়েল, মাওলানা আবদুর রউফ, মাওলানা সাব্বির আহমেদ, আরিফ হাসান ওরফে সুমন, আবু বকর ওরফে হাফেজ সেলিম মাওলাদার, মো. আরিফুল ইসলাম, মহিবুল মুত্তাকিন ওরফে মুত্তাকিন, আনিসুল মুরছালিন ওরফে মুরছালিন, মো. খলিল ওরফে খলিলুর রহমান, জাহাঙ্গীর আলম বদর, মো. ইকবাল ওরফে ইকবাল হোসেন, লিটন ওরফে মাওলানা লিটন, মুফতি শফিকুর রহমান, মুফতি আব্দুল হাই, রাতুল আহমেদ ওরফে রাতুল বাবু। তাদেরকে দণ্ডবিধির ৩০২/১২০খ/৩৪ ধারায় দোষী সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়ার পাশাপাশি প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা, অনাদায়ে আরও এক বছর সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

এছাড়াও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজি) মো. আশরাফুল হুদা ও শহিদুল হক, বিএনপি চেয়ারপারসন ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ভাগনে লেফটেন্যান্ট কমান্ডার (অব.) সাইফুল ইসলাম ডিউক, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দ্দার, ডিজিএফআইয়ের মেজর জেনারেল (অব.) এটিএম আমিন, ডিএমপির সাবেক উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) খান সাঈদ হাসান, আরেক সাবেক উপ-কমিশনার (পূর্ব) ওবায়দুর রহমান খান, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক খোদা বক্স চৌধুরী, সিআইডির সাবেক বিশেষ সুপার মো. রুহুল আমিন, সাবেক এএসপি আবদুর রশিদ, সাবেক এএসপি মুন্সি আতিকুর রহমানকে দুই বছর করে কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও ছয় মাস করে সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। আরেকটি ধারায় খোদা বক্স চৌধুরী, রুহুল আমিন, আবদুর রশিদ ও মুন্সি আতিকুর রহমানকে তিন বছর করে কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও ছয় মাস করে কারাদণ্ড দেন আদালত।

এরপর ২০১৮ সালের ২৭ নভেম্বর মামলার বিচারিক আদালতের রায় ও প্রয়োজনীয় নথিসহ হাইকোর্টের ডেথ রেফারেন্স শাখায় এসে পৌঁছে। পরে ২০২০ সালের ১৬ আগস্ট প্রায় ৩০ হাজার পৃষ্ঠার পেপারবুক বিজি প্রেস থেকে তৈরির পর সুপ্রিম কোর্টে এসে পৌঁছায়।

এরপর ২০২২ সালের ৫ ডিসেম্বর থেকে বিচারপতি সহিদুল করিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চে মামলার আপিল শুনানি শুরু হয়। শুরুতে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে বিচারিক আদালতের রায় ও সাক্ষীদের বক্তব্য আদালতকে পড়ে শোনানো হয়।

মামলাটি প্রসঙ্গে সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন চলতি বছরের শুরুতে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেছিলেন, ‘আমরা মামলাটির প্রায় ৩০ হাজার পৃষ্ঠার পেপারবুকের মধ্যে আর মাত্র এক-দেড়শো পৃষ্ঠা পড়া বাকি আছে। তারপর আমরা রাষ্ট্রপক্ষের বক্তব্য তুলে ধরবো। আশা করছি আর মাত্র ১০/১২ কার্যদিবস সময় লাগতে পারে শুনানি শেষ হতে।’

মামলাটির বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে আদালত সূত্রে জানা গেছে, দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তন ও নতুন প্রধান বিচারপতি দায়িত্ব গ্রহণের পর হাইকোর্টের বেঞ্চসমূহ পুনর্গঠন করা হয়। পূর্বে এই মামলাটি বিচারপতি সহিদুল করিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চে শুনানি হয়েছিল। তবে নতুন করে হাইকোর্টের আরও কিছু বেঞ্চের মতো এই বেঞ্চটি পুনর্গঠিত হওয়ায় বিচারপতি সহিদুল করিমের সঙ্গে বিচারপতি মো. আতাবুল্লাহকে একসঙ্গে বিচারিক কার্য পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। গত ১৮ আগস্ট বিচারপতি সহিদুল করিম ও বিচারপতি মো. আতাবুল্লাহ এর নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চে শুনানিতে ওঠে। তবে বেঞ্চটির কণিষ্ঠ বিচারপতি পরিবর্তন ও এর আগে মামলাটির শুনানিতে তিনি না থাকায় নিয়ম অনুসারে নতুন করে মামলাটি শুনানির জন্য আদেশ দেন আদালত। আসন্ন সুপ্রিম কোর্টের অবকাশকালীন ছুটির (সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর) পর মামলাটি নতুন করে শুনানির জন্য দিন ধার্য রাখা হয়েছে।

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ব্যারিস্টার এএম মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, যারা ২১ আগস্ট হামলার ঘটনা ঘটিয়েছে, তারা কিন্তু শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে চায়নি। তারা চেয়েছিল, দেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে। বিএনপি সরকার যেন ক্ষমতায় না থাকতে পারে। এই অস্থিতিশীলতার পরিস্থিতি তৈরি করায় পরবর্তীতে এক-এগারো সরকার আসলো। এ ঘটনার সঙ্গে সাবেক সেনা প্রধান মঈন ইউ আহমেদ ও ড. ফখরুদ্দিন আহমদ জড়িত থাকতে পারেন। মূলত এক-এগারো সৃষ্টি করার জন্যই ২১ আগস্টের ঘটনা ঘটেছে। যা দুঃখজনক ও ন্যক্কারজনক। ন্যায় বিচারের স্বার্থে এ ঘটনায় জড়িত প্রকৃত আসামিদের বিচারের আওতায় আনা জরুরি।