ঢাকায় নারীদের ‘রাত দখল’ প্রতিবাদী গান-কবিতা ও

কলকাতায় আর জি কর হাসপাতালে নারী চিকিৎসককে ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় সেখানে চলছে ‘মেয়েরা রাত দখল করো’ কর্মসূচি। সেই কর্মসূচির সঙ্গে সংহতি জানিয়ে ঢাকায়ও পালিত হয়েছে ‘রাত দখল’ কর্মসূচি।

শুক্রবার (১৬ আগস্ট) রাত ১০টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) এলাকায় শুরু হয় এই কর্মসূচি। এ সময় প্রতিবাদী গান-কবিতা পরিবেশনের পাশাপাশি বক্তব্য দেন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারীরা। এরপর রাত ১১টা ২০ মিনিটে রাজু ভাস্কর্যের সামনে থেকে মশাল মিছিল নিয়ে ভিসি চত্বর হয়ে আবারও রাজু ভাস্কর্যে এসে সাংস্কৃতিক পরিবেশনার আয়োজন করা হয়।

কলকাতার সঙ্গে সংহতি জানিয়ে ঢাকায়ও পালিত হয় ‘রাত দখল’ কর্মসূচি (ছবি: সাজ্জাদ হোসেন)কর্মসূচির শুরুতে ইসরাত জাহান ইমু অবস্থানপত্র পাঠ করেন। অবস্থানপত্র পাঠকালে তিনি বলেন, ‘আমরা গত ১৬ বছর ধরে দেখে এসেছি কী অসংবেদনশীল বিচার ব্যবস্থা এখানে বিদ্যমান থেকেছে। লাখ লাখ নারী নির্যাতনের মামলা বছরের পর বছর ট্রাইব্যুনালে আটকে থেকেছে। নারী ও শিশু ট্রাইব্যুনালে পর্যাপ্ত বিচারক থাকতো না মামলাগুলোর বিচারের জন্য। সহিংসতার ভিকটিমকে হার মানতে হতো আদালতের দীর্ঘসূত্রতা, ক্ষমতার দৌরাত্ম্য ও পিতৃতান্ত্রিক বিচার ব্যবস্থার কাছে, যেখানে একজন সহিংসতার শিকার নারীকে প্রমাণ দিতে হয় যে সে নিজে সহিংসতার শিকার হয়েছে।’

প্রতিবাদী বক্তব্য দেন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারীরাএ সময় তিনি আরও বলেন, ‘আমরা যদি তনুর কথা আজ স্মরণ করি, তবে দেখবো তনুর ধর্ষণ ও হত্যাকারীরা কীভাবে ক্ষমতা দেখিয়ে পার পেয়ে গেছে। তার পোস্টমর্টেম নিয়ে কী ন্যক্কারজনক নাটকীয়তা হয়েছে! যদি মুনিয়ার ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের কথা স্মরণ করি, অভিযুক্ত নির্যাতক বসুন্ধরার এমডি আনভীরকে কোনোপ্রকার তদন্তের মুখোমুখি না করেই অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে মামলা থেকে। আমাদের আদিবাসী বোনরা সেনাবাহিনী কর্তৃক তাদের একাধিক ধর্ষণ এবং নির্যাতনের ঘটনায় কোনও বিচার ও সুরাহা পাননি। এই ক্ষমতার দৌরাত্ম্যের মূল কেন্দ্র ছিল ফ্যাসিবাদী আওয়ামী শাসন ব্যবস্থা। আমাদের সংগ্রামী ছাত্র-জনতা রক্ত দিয়ে সেই শাসন ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়েছে।

‘আজ আমরা বিশ্বাস করি, এই নতুন বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদী আর কোনও উপাদান থাকবে না। আমাদের বিচার বিভাগ স্বাধীন হবে, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ হবে, জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে।’

সমাবেশে অংশ নেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা এস মুরশিদ। রাষ্ট্রীয় কাঠামোকে কীভাবে কাজে লাগানো যায়, সে বিষয়ে নারীদের কাছে একটি প্রস্তাব চান তিনি। তিনি বলেন, ‘তোমরা যদি রাস্তায় থাকো, তাহলে আমিও রাস্তায়। তোমরা যদি অনিরাপদ হও, তাহলে নিরাপত্তাহীনতা কীভাবে দূর করবো, তা নিয়ে কাজ করতে হবে। যে সরকার হয়েছে, তা তোমাদের সরকার।’

রাজু ভাস্কর্যের সামনে থেকে মশাল মিছিল বের করা হয়এ সময় তিনি আরও বলেন, ‘আমাকে কিছু প্রস্তাব দিতে পারবে? তাহলে আমরা ঝাঁপিয়ে পড়বো। আমি তোমাদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতো চাই। বলো, রাষ্ট্রীয় কাঠামো কীভাবে কাজে লাগাবো। এজন্য আমি এখানে এসেছি। তোমরা আমাদের কাছে নিরাপত্তা চেয়েছো, সত্যিই আমরা পারিনি। আমি জানি, কারণ আমরা স্টাডি করেছি, তোমরা কী পরিমাণ নিরাপত্তাহীন।’

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রেজওয়ানা স্নিগ্ধা বলেন, ‘আমরা বারবার অন্যায়ের বিপক্ষে কথা বলি। এই যে পাশবিক নির্যাতন, ধর্ষণ, এটি যেকোনও অপরাধের মধ্যে সবচেয়ে জঘন্যতম। ধর্ষণ শুধু নারীর সঙ্গে হয়, এমন না; শিশুদের সঙ্গেও হচ্ছে অহরহ। এগুলো নিয়েও আমাদের কথা বলতে হবে। আমরা শুনেছি, পোশাক দিয়ে ধর্ষণকে ধামাচাপা দেওয়ার গল্প, আমরা শুনেছি পোশাক দিয়ে সিডিউস করার গল্প। পোশাকের সঙ্গে ধর্ষণের কোনও সম্পর্ক নেই।’

এই শিক্ষক আরও বলেন, ‘আজকে মৌমিতার গল্প শুধু মৌমিতার গল্প না৷ এটি সীমা ছাড়িয়ে যাওয়ার গল্প। আমরা বলি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় রাতে নারীদের জন্য নিরাপদ। কেন শুধু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, কেন দেশের পুরোটা সীমানা রাতেও নারীদের জন্য নিরাপদ নয়? কেন আমাকে বের হওয়ার আগে চিন্তা করতে হয়, আমি হাঁটতে বের হবো কি হবো না! আমার সীমানা কোনোভাবে নির্ধারিত হবে না।’

আরও বক্তব্য দেন– রুপা চাকমা, ইডেন কলেজের শিক্ষার্থী সাইমা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী আলেয়া তাহমিমসহ অনেকে। এ সময় সুপ্তি, ফাইরা ফাইরুজ রিমঝিম গান ও কবিতা  পরিবেশন করেন।

নারীর প্রতি সহিংসতার প্রতিবাদএ সময় নারীরা ১৩ দফা দাবি পেশ করেন। সেগুলো হলো: ১. তনু, মুনিয়াসহ প্রতিটি ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত এবং বিচার করতে হবে।

২. নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলা ১৮০ দিনের মধ্যেই নিষ্পত্তি করতে হবে।

৩. ধর্ম, গোত্র, বর্ণের ঊর্ধ্বে গিয়ে প্রতিটি লিঙ্গের মানুষের সম্পত্তিতে সমানাধিকার দিতে হবে।

৪. ইউনিফর্ম ফ্যামিলি কোড চালু এবং বাস্তবায়ন করতে হবে।

৫. সন্তানের অভিভাবকত্ব আইন পরিবর্তন করতে হবে। নারীকে সন্তানের অভিভাবকত্ব দিতে হবে।

৬. ২০০৯ সালের হাইকোর্ট নীতিমালা অনুযায়ী প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কর্মস্থলে যৌন নিপীড়নবিরোধী কমিটি ও সেল তৈরি এবং কার্যকর করতে হবে।

৭. নারী, আদিবাসী, প্রতিবন্ধী এবং ভিন্ন লৈঙ্গিক পরিচয়ের মানুষের প্রতিনিধিত্বের জন্য যৌক্তিক অনুপাতে কোটা বরাদ্দ দিতে হবে।

৮. ১৮৬০ সালের গর্ভপাতের আইন বাতিল করতে হবে। নারীকে গর্ভপাতের পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে হবে।

৯. নারী এবং লিঙ্গ বৈচিত্র্যের মানুষের জন্য সমান কর্মসংস্থানের সুযোগ দিতে হবে এবং নিরাপদ কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে হবে।

১০. প্রতিটি ভিন্ন ভিন্ন লৈঙ্গিক পরিচয়ের মানুষের রাষ্ট্রীয় পরিচয়পত্রে তার লৈঙ্গিক পরিচয়ের স্বীকৃতি দিতে হবে।

১১. সব ধরনের লৈঙ্গিক বৈষম্যকারী আইন বাতিল করতে হবে।

১২. বিচার বিভাগে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতের জন্য বিচার বিভাগকে স্বাধীন করতে হবে।

১৩. আন্তর্জাতিক চুক্তি মেনে রাষ্ট্রের সব পর্যায়ে নারীর ৩৩% অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।