সন্তানকে বুকে জড়িয়ে মৃত্যু

সন্তানকে বুকে জড়িয়ে মৃত্যু

পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা মায়ের কোলে থেকেও বাঁচতে পারল না তিন বছরের ছোট্ট ইয়াছিন রহমান। আর আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেও কোলের মানিককে বাঁচাতে পারেননি মা নাদিরা আক্তার পপি। বাঁচতে পারেননি নিজেও। একে অন্যকে আলিঙ্গন করেই মৃত্যুর স্বাদ নিয়ে একসঙ্গে পৃথিবী ছাড়লেন মা ও সন্তান। ১০ মাস গর্ভে রেখে পৃথিবীর আলো দেখিয়েছিলেন সন্তানকে। স্নেহের পরশে সযত্নে বড় করে তুলছিলেন। মাকে জড়িয়ে বেড়ে ওঠার কথা ছিল যে শিশুর, সেই শিশু পৃথিবীর মায়া ছেড়েছে মাকে জড়িয়ে ধরেই। আগুন থেকে বাঁচাতে যেভাবে সন্তানকে বুকে আগলে রেখেছিলেন মা, ঢাকা মেডিকেলের মর্গের বাইরে লাশবাহী সাদা ব্যাগেও একইভাবে রাখা ছিল তাদের লাশ।

মঙ্গলবার ভোর ৫টার দিকে রাজধানীর তেজগাঁও স্টেশনে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসে দুর্বৃত্তদের দেওয়া আগুনে পুড়ে মারা গেছেন মা-ছেলে। এ ঘটনায় নিহত হয়েছেন আরও দুজন। এর মধ্যে একজন নেত্রকোনা শহরের নাগড়া এলাকার বাসিন্দা এবং নেত্রকোনা পৌর বিএনপির সদস্য রশিদ ঢালী। রাত ৮টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত আরেকজনের লাশ শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি।

ঘটনার পর মঙ্গলবার দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গের সামনে বসেছিলেন নাদিরার স্বামী মিজানুর রহমান। দুর্বৃত্তদের এই আগুনে তার জীবনে মুহূর্তেই নেমে এসেছে ঘোর অন্ধকার। স্ত্রী-সন্তানকে হারিয়ে শোকে পাথর হয়ে গেছেন তিনি। মাঝেমধ্যে বিলাপ করে বলছিলেন, আমার কী হলো। কী অপরাধ করেছিলাম আমি। আমার সব শেষ হয়ে গেল।

তেজগাঁও এলাকায় হার্ডওয়্যারের ব্যবসা করেন মিজানুর রহমান। বাসা পশ্চিম তেজতুরী বাজার এলাকায়। দুই ছেলে ও স্ত্রী সেখানেই থাকতেন তার সঙ্গে। বড় ছেলে রিয়াদ হাসান ফাহিম স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। ছেলের বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর দুই সন্তান নিয়ে গ্রামের বাড়ি দক্ষিণ বিশিউড়া গিয়েছিলেন নাদিরা। সোমবার রাতে দুই সন্তান এবং তার ভাই হাবিবুর রহমানকে সঙ্গে নিয়ে মোহনগঞ্জ থেকে ফিরছিলেন ঢাকায়। ট্রেনে আগুনের ঘটনার সময় হাবিবুর রহমান ভাগ্নে ফাহিমকে নিয়ে ট্রেন থেকে নেমে জীবন বাঁচাতে পারলেও ট্রেনে আটকে পড়ে মারা যান নাদিরা ও ইয়াছিন।

মিজানুর বলেন, রাতে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসে ওঠার পর নাদিরার সঙ্গে কথা হয়েছিল। মঙ্গলবার ভোর ৫টার দিকে নাদিরার ভাই ফোন করে আগুন লাগার খবর দেন। বাসা থেকে দ্রুত তেজগাঁও রেলস্টেশনে পৌঁছাই। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা যখন চারটি লাশ নামায়, দেখি আমার স্ত্রী-সন্তান পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেছে।

নাদিরার বাবা মো. ফজলুল হক বলেন, ‘আমার মেয়ের সঙ্গে শেষ দুইটা কথাও বলতে পারলাম না। আগুন তো ট্রেনে দেয় নাই, আগুন দিছে আমার বুকে। আমি এই ঘটনার বিচার চাই।’

এদিকে আগুনের ঘটনায় নিহত নেত্রকোনা শহরের নাগড়া এলাকার বাসিন্দা রশিদ ঢালীর পরিবারেও চলছে শোকের মাতম। নিহতের খবরে স্বজনসহ এলাকাবাসী তাদের বাড়িতে আসেন সমবেদনা জানাতে। নিহতের ছেলে মামুন ঢালী বলেন, ‘আমার বাবা ব্যবসার কাজে মালপত্র কিনতে ঢাকা গেছিল ট্রেইনে। জীবনের লাইগ্যা গেছেগা। আর আইবো না।’

ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার হাবিবুর রহমান বলেন, ঘটনার সময় ভোর থাকায় অনেকে যাত্রী ঘুমন্ত অবস্থায় ছিলেন। এক মা নাদিরা আক্তার পপি যার তিন বছরের শিশু সন্তানকে জড়িয়ে ধরে ছিলেন। মা ও সন্তান উভয়ই বাঁচার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু তাদের নির্মম মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় আরও দুজন মারা গেছেন। এই নাশকতার সঙ্গে জড়িতদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় নেওয়া হবে।