রাজশাহীতে আওয়ামী লীগের অন্তর্কলহ কি নির্বাচন পর্যন্ত গড়াবে

রাজশাহীতে আওয়ামী লীগের অন্তর্কলহ কি নির্বাচন পর্যন্ত গড়াবে

রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আগে বেশ কয়েকটি ঘটনায় মহানগর ও জেলার নেতাদের মধ্যে অন্তর্কলহ দৃশ্যমান হয়েছে। এই কলহ নির্বাচন পর্যন্ত গড়াবে কি না, তা নিয়ে দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে আলোচনা আছে। তবে নির্বাচনের মেয়র প্রার্থী ও বর্তমান মেয়র খায়রুজ্জামান লিটন দাবি করছেন, সময়মতো সব ঠিক হয়ে যাবে। যে যাঁর দায়িত্ব পালন করবেন।

আগামী ২১ জুন রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচন। এতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র তুলেছেন দলটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য খায়রুজ্জামান লিটন। নির্বাচনের প্রচার-প্রচারণা এখনো শুরু হয়নি। কিন্তু প্রতিদিন একটি-দুটি করে মতবিনিময় সভার মাধ্যমে নির্বাচনী কাজ এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এসব কর্মসূচি চলছে রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকারকে বাদ দিয়েই।

গত ১৫ এপ্রিল দলীয় মনোনয়ন নিয়ে রাজশাহীতে এসে মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন নগরের কুমারপাড়ায় দলীয় কার্যালয়ে একটি সংবাদ সম্মেলন ডেকেছিলেন। সেখানে উপস্থিত ছিলেন না মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকার। এর আগেও তাঁকে বাদ দিয়ে কয়েকটি সভা হয়।

দলের সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকারকে বাদ দিয়ে নির্বাচন করতে গেলে ফলাফলের ওপর কোনো প্রভাব পড়বে কি না, ওই সংবাদ সম্মেলনে জানতে চেয়েছিলেন সাংবাদিকেরা। এর জবাবে রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী কামাল বলেছিলেন, আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও সহযোগী সংগঠনের ৯৯ ভাগ নেতা-কর্মী একসঙ্গে আছেন। রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের সবাই একসঙ্গে আছেন। এ নির্বাচনে তাঁর (ডাবলু সরকারের) অনুপস্থিতি বিন্দুমাত্র প্রভাব ফেলতে পারবে না।

এরপর গত রোববার (৭ মে) নির্বাচনের মনোনয়নপত্র তোলার সময়ও ডাবলু সরকার ছিলেন না। আনুষ্ঠানিক প্রচারণা শুরু না হলেও দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার পর থেকে গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত খায়রুজ্জামান লিটন বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ও পেশার লোকজনের সঙ্গে ২৫টি মতবিনিময় সভা করেছেন। এগুলোর কোনোটিতেই ডাবলু সরকার ছিলেন না। তাঁকে বাদ দিয়ে এভাবে কর্মসূচি এগিয়ে নেওয়ার বিষয়টি রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনায় জন্ম দিচ্ছে।

গত ১১ ফেব্রুয়ারি জেলার পুঠিয়ায় শান্তি সমাবেশ কর্মসূচিতে প্রধান অতিথি ছিলেন খায়রুজ্জামান লিটন। এ সমাবেশের ব্যানারে প্রধান বক্তা হিসেবে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল ওয়াদুদের নাম ছিল। তিনি সেই সমাবেশ বর্জন করে পৃথক সমাবেশ করেছিলেন।

পুঠিয়ার বানেশ্বরের আওয়ামী লীগ আয়োজিত ‘শান্তি সমাবেশে’ না থাকার ব্যাপারে আবদুল ওয়াদুদ সে সময় কোনো বক্তব্য দেননি। তাঁর অনুসারীদের একটি সূত্র থেকে জানা যায়, ওই সভায় রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান উপস্থিত থাকবেন, সেই খবর পেয়েই তাঁরা সমাবেশ বর্জন করেছেন। সে সময় খায়রুজ্জামান লিটন প্রথম আলোকে বলেছিলেন, আসাদুজ্জামান রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের দুই নম্বর সম্মানিত সদস্য। দল তাঁকে বহিষ্কার করেনি। তিনি সমাবেশে থাকতেই পারেন। বর্তমানে খায়রুজ্জামান লিটনের প্রায় সব কর্মসূচিতেই থাকছেন আসাদুজ্জামান।

এদিকে রাজশাহীতে জেলা আওয়ামী লীগের দুটি কার্যালয় করা হয়েছে। নগরের সিটিহাট এলাকার কার্যালয়টির জমি দিয়েছেন বাগমারার সংসদ সদস্য এনামুল হক। সেই কার্যালয়ে একটি ইফতার অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। এই অনুষ্ঠানে খায়রুজ্জামান লিটন উপস্থিত থাকলেও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ বেশ কিছু নেতা অনুপস্থিত ছিলেন। সংসদ সদস্যদের মধ্যে শুধু এনামুল হক ও পুঠিয়া-দুর্গাপুরের সংসদ সদস্য মনসুর রহমান উপস্থিত ছিলেন।

সাম্প্রতিক এ ধরনের কয়েকটি ঘটনায় রাজশাহীতে আওয়ামী লীগের অন্তর্কলহ দৃশ্যমান হয়েছে। এ ব্যাপারে রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি অনিল কুমার সরকার বলেন, রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটনের মনোনয়নপত্র তোলার সময় তিনি ছিলেন। দলের সাধারণ সম্পাদক দেশের বাইরে রয়েছেন। অতীতে যে যা-ই করুক, শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তের বাইরে কেউ যেতে পারবেন না। সিটি এলাকার কার্যালয়ে অনুপস্থিত থাকার ব্যাপারে তিনি বলেন, তখন তিনি চিকিৎসার জন্য ভারতে ছিলেন।

জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল ওয়াদুদ বর্তমানে দেশের বাইরে আছেন। তিনি মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘লিটন ভাইয়ের চেয়ে ভালো প্রার্থী হয় না। নির্বাচনের আগে ছোটখাটো যা-ই ঘটুক, আমরা সবাই মিলে একসঙ্গে তাঁর জন্য কাজ করব।’

রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকার প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোনো ঘটনার ব্যাপারে আমার বিরুদ্ধে কেউ ব্যক্তিগত বা রাজনৈতিকভাবে অভিযোগ করেননি। সেটা এখন কোনো আলোচ্য বিষয় নয়। আসলে দলীয় মনোনয়ন চাওয়াটাই আমার অপরাধ হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘আমার ওপর তো স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার জন্য অনেক চাপ ছিল। কিন্তু আমি রাজি হইনি। আমি বলেছি, জননেত্রী শেখ হাসিনা যাঁকে নৌকার প্রার্থী ঘোষণা করবেন, আমি তাঁর পক্ষেই শতভাগ কাজ করব। তবে আমাকে ও আমার অনুসারীদের বাদ দিয়ে বর্তমানে নির্বাচনী কার্যক্রম চালানো হলেও মেয়র প্রার্থীর প্রতীক বরাদ্দ হলে আমি আমার মতো কাজ করব।’

এসব ব্যাপারে জানতে চাইলে এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন প্রথম আলোকে বলেন, ‘যাঁদের কথা বলা হচ্ছে তাঁদের ভূমিকা অতটা গণমুখী নয়। আর ডাবলু সরকার রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। এ হিসেবে সময়মতো নির্বাচনে সে তার দায়িত্ব পালন করবে বলে আমার বিশ্বাস।’

দলীয় মনোনয়ন নিয়ে রাজশাহীতে ফিরে সংবাদ সম্মেলনে নেতা-কর্মীরা দাবি তুলেছিলেন যে ডাবলু সরকারকে বাদ দিয়ে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে। বিষয়টি রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মেয়র প্রার্থী হিসেবে আপনি কীভাবে দেখেন, জানতে চাইলে খায়রুজ্জামান লিটন বলেন, ‘একটা ঘটনার কারণে দলের নেতা-কর্মীরা ডাবলু সরকারের ওপর অসন্তুষ্ট। বিষয়টি প্রমাণ হলে এক রকম, না হলে আরেক রকম। সেটা যতক্ষণ না হচ্ছে, ততক্ষণ দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ডাবলু সরকার নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করবে, এটা আমার বিশ্বাস। আর জেলার ক্ষেত্রে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি অনিল দলীয় মনোনয়ন জমা দেওয়ার সময় সঙ্গেই ছিলেন। আর সাধারণ সম্পাদক দেশের বাইরে। তিনি ফিরে এলে সময়মতো দায়িত্ব পালন করবেন। এখানে কোনো বিভক্তি থাকবে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *