পূর্ব পাকিস্তানের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে: ইমরান খান

পূর্ব পাকিস্তানের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে: ইমরান খান

পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের গ্রেপ্তারকে ঘিরে ছড়িয়ে পড়া বিক্ষোভের পর তাঁর দল পাকিস্তান তেহরিক–ই–ইনসাফের (পিটিআই) অনেক নেতা ও বেশ কয়েকজন সাংবাদিককে তুলে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এ নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করে ইমরান বলেছেন, এ ধরনের পরিস্থিতি পাকিস্তানকে পূর্ব পাকিস্তানের মতো পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যাবে।

গ্রেপ্তারের পর জামিনে মুক্ত হয়ে গত শনিবার জামান পার্কে তাঁর বাসা থেকে ভার্চ্যুয়াল এক ভাষণে এমন আশঙ্কার কথা বলেন ইমরান খান। ভাষণে তিনি সাংবাদিক ইমরান রিয়াজ খানকে অজ্ঞাত স্থানে তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনায় নিন্দা জানান। বলেন, ইমরান রিয়াজ খানকে অজ্ঞাত স্থানে তুলে নিয়ে নির্যাতনের আশঙ্কা করছেন তিনি (ইমরান খান)। কারণ, তিনি (ইমরান রিয়াজ) আমদানি করা এই সরকারের কাছে মাথা নত করেননি।

ইমরান খান আরও অভিযোগ তোলেন, আফতাব ইকবালসহ আরও অনেক সাংবাদিককে তুলে নিয়ে নির্যাতন করা হয়েছে। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, এ ধরনের পরিস্থিতি পাকিস্তানকে পূর্ব পাকিস্তানের মতো পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যাবে।

ইমরান খান তাই জনগণকে দলে দলে বাড়ি থেকে বের হয়ে আসতে বলেন। তিনি ‘হককি আজাদি’ লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে রাস্তায় নামতে বলেন সমর্থকদের। এ ছাড়া রোববার ‘সংবিধান বাঁচাও, দেশ বাঁচাও’ স্লোগানে এক ঘণ্টার জন্য জনগণকে রাস্তায় দাঁড়াতে আহ্বান জানান।

৯ মে ইমরান খানকে গ্রেপ্তারের পর দেশজুড়ে মারাত্মক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। ১১ মে পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট আল-কাদির ট্রাস্ট মামলায় ইমরান খানের গ্রেপ্তার ‘বেআইনি’ ঘোষণা করেন। শুক্রবার ওই মামলায় ইসলামাবাদ হাইকোর্ট তাঁকে দুই সপ্তাহের জামিন দেন।

ইমরান খান গত বছরের এপ্রিলে অনাস্থা ভোটে হেরে ক্ষমতাচ্যুত হন। এর পর থেকে তাঁর বিরুদ্ধে কয়েক ডজন মামলা হয়েছে। তাঁকে গ্রেপ্তারের ঘটনায় ক্ষুব্ধ সমর্থকেরা সরকারি ভবনে আগুন লাগান। রাস্তা বন্ধ করে সামরিক স্থাপনা ধ্বংস করেন। ইমরান খানের সরকার পতনের জন্য সেনাবাহিনীকে দায়ী করে আসছেন তাঁর সমর্থকেরা।

কারামুক্ত হয়ে শনিবার রাতে প্রথমবারের মতো বক্তব্য দেন ইমরান। ইউটিউবে ওই বক্তব্য প্রচারিত হয়। ইমরান বলেন, ‘স্বাধীনতা (আজাদি) সহজে আসে না। একে ছিনিয়ে নিতে হয়। এর জন্য ত্যাগ স্বীকার করতে হবে।’

ইমরান তাঁর সমর্থকদের রোববার বিক্ষোভ করতে বলেন। গ্রামের সড়ক ও প্রান্তে সমর্থকদের দেশজুড়ে বিক্ষোভ চালিয়ে যেতে বলেন। এ ছাড়া অবিলম্বে নির্বাচনের জন্য বুধবার বিক্ষোভ শুরুর ঘোষণা দেন।

কয়েক মাস ধরে পিটিআই নেতা ইমরান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সোচ্চার। গত বছর লংমার্চের সময় তাঁর ওপর হামলায় পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তারা জড়িত ছিলেন, এমন অভিযোগ তোলার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়।

দেশটির স্বাধীনতার ৭৫ বছরের ইতিহাসের প্রায় অর্ধেক সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনী প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ক্ষমতায় থেকেছে। লাহোরে নিজ বাড়ি থেকে দেওয়া বক্তব্যে ইমরান খান তাঁকে গ্রেপ্তারের পেছনে সেনাপ্রধানের হাত রয়েছে বলে অভিযোগ তোলেন। তিনি বলেন, ‘সেনাপ্রধানের কার্যক্রম আমাদের সেনাবাহিনীর বদনাম করেছে। তাঁর জন্যই সেনাবাহিনীর দুর্নাম হয়েছে, আমার জন্য নয়।

তবে তিনি বর্তমান সেনাপ্রধান নাকি সাবেক সেনাপ্রধানের কথা বলেছেন, তা স্পষ্ট নয়। ক্ষমতা থেকে হটানোর জন্য সাবেক সেনাপ্রধান কামার জাভেদ বাজওয়াকে দায়ী করে আসছেন ইমরান খান।

রোববার ইমরান খান সামরিক স্থাপনায় হামলা ও সহিংসতার ঘটনায় তাঁর দলের সংশ্লিষ্টতার কথা নাকচ করে দেন। তিনি এ সহিংসতার নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি করেছেন। এদিকে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে ইমরানের অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে। শনিবার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অপপ্রচারের বিরুদ্ধে সতর্ক করা হয়েছে।

দেশটির পুলিশ বাহিনী ও হাসপাতাল সূত্র বলেছে, ইমরান খানকে গ্রেপ্তারের পর সৃষ্ট সহিংসতায় ৯ জন নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া কয়েক শ পুলিশ কর্মকর্তা আহত হয়েছেন। এ ছাড়া ৪ হাজারের বেশি মানুষকে আটক করা হয়েছে। আটক ব্যক্তিদের বেশির ভাগই পাঞ্জাব ও খাইবার পাখতুনখাওয়ার বাসিন্দা। ইমরান খানের আইনজীবীদের ভাষ্য, ইমরান খানের গ্রেপ্তার ঘিরে বিক্ষোভ শুরু হলে পিটিআইয়ের ১০ জন জ্যেষ্ঠ নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

২০১৮ সালে দুর্নীতিবিরোধী প্রচার চালিয়ে ক্ষমতায় আসেন ইমরান। স্বাধীন বিশ্লেষকেরা মনে করেন, সেনাবাহিনীর সহায়তার ক্ষমতায় বসেছিলেন তিনি। অবশ্য পরে সেনাবাহিনীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক খারাপ হয়ে দাঁড়ায়। ২১ বছর বয়সী পিটিআই সমর্থক মহসিন খান বলেন, ‘ইমরান খানকে গ্রেপ্তারের পেছনে কে, তা প্রত্যেকেই জানেন। এর পেছনে সেনাবাহিনী রয়েছে।’ পেশায় ফুটপাতের ওই দোকানি বলেন, তিনি চান রাজনীতিবিদ ও সেনাবাহিনী একত্রে কাজ করুক।

কয়েক মাস ধরেই পাকিস্তানের রাজনৈতিক অঙ্গনে অস্থিরতা চলছে। ইমরান খান বর্তমান জোট সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে ও আগাম নির্বাচনের দাবিতে তাঁর দলের নিয়ন্ত্রণে থাকা দুটি প্রাদেশিক সরকার ভেঙে দেন।

গত মঙ্গলবার ইমরান খানকে গ্রেপ্তারের পর দেশটির মোবাইল ডেটা সেবা ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। শনিবার থেকে তা আংশিক চালু হয়েছে।

পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) দলের প্রধান ইমরান খান বলেছেন, কিছু লোক তাঁর ব্যাপারে সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনিরকে বিভ্রান্ত করছে। তিনি ইতিমধ্যে সেনাপ্রধানকে বার্তা পাঠিয়েছেন।

শুক্রবার ইসলামাবাদ হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে বিদেশি গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপকালে পাকিস্তানের সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনি কখনোই আসিম মুনিরের বিরুদ্ধে নেতিবাচক বক্তব্য দেননি। পিটিআই ক্ষমতায় এলে তিনি সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনিরের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখবেন। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় দেশটির প্রেসিডেন্ট আরিফ আলভির সঙ্গে ইমরান খানের বৈঠক হয়। এ বৈঠকে কোনো সমঝোতা হওয়ার কথা আগেই প্রত্যাখ্যান করেন ইমরান খান।

ইসলামাবাদ হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে ইমরান খান বলেন, প্রেসিডেন্ট আলভি ‘কারও বার্তা’ নিয়ে বৈঠকে আসেননি। বৈঠকে কোনো সমঝোতাও হয়নি। সহিংস বিক্ষোভ প্রসঙ্গে পিটিআইয়ের প্রধান বলেন, নেতার তত্ত্বাবধান ছাড়াই জনতা যখন রাজপথে নেমে আসে, তখন তা ‘নিয়ন্ত্রণের বাইরে’ চলে যায়।

শনিবার পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ সতর্ক করে বলেছেন, সহিংসতায় জড়িত, উসকানি ও মদদদাতাদের ৭২ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তার করা হবে। রাষ্ট্রবিরোধী আচরণকারীদের গ্রেপ্তার করে সন্ত্রাসবিরোধী আদালতে বিচার করা হবে। পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রানা সানাউল্লাহ একাধিকবার বলেছেন, ইমরান খানকে পুলিশ আবার গ্রেপ্তার করবে। আগামী অক্টোবরে দেশটির জাতীয় নির্বাচনের আগে ইমরান খানের জনপ্রিয়তা বেড়েছে। হাইকোর্টের রায় অনুযায়ী, সোমবার পর্যন্ত ইমরান খানকে গ্রেপ্তার করা যাবে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *