নওগাঁয় বোরোর ভালো ফলন ও দামে খুশি কৃষক

নওগাঁয় বোরোর ভালো ফলন ও দামে খুশি কৃষক

ধান উৎপাদনে সমৃদ্ধ জেলা হিসেবে নওগাঁর বেশ পরিচিতি রয়েছে। এখানকার কৃষক পরিবারের সদস্যরা এখন ব্যাপক উৎসাহ–উদ্দীপনায় মাঠে মাঠে বোরো ধান কাটা ও মাড়াইয়ের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। তাঁরা বলছেন, পোকামাকড় ও রোগবালাই কম হওয়ায় এবার ধানের ফলন ভালো হয়েছে। বাজারে ধানের দামও ভালো পাওয়া যাচ্ছে।

এবার নওগাঁয় জিরাশাইল (কৃষকেরা বলেন জিরা), কাটারিভোগ, উচ্চফলনশীল (উফশী) ব্রি-২৮, ব্রি-৯০ ও শুভলতা জাতের ধান বেশি চাষ হয়েছে। কৃষকেরা বলছেন, মাঝে লোডশোডিংয়ের কারণে পানি সেচে সংকট দেখা দিলেও শেষ পর্যন্ত ফলনে তেমন প্রভাব পড়েনি। বিঘাপ্রতি ২২ থেকে ২৫ মণ ধান পাচ্ছেন তাঁরা। পর্যাপ্ত কামলা না পাওয়ার কারণে ধান কাটা-মাড়াই কিছুটা ধীরে হচ্ছে। বাইরের জেলা থেকে এলাকায় এবার খুব কম কামলা আসিছে। তাই ধান কাটা কামলা লিয়ে গেরস্তরা টানাটানি করোছে।

আনসার আলী কৃষক, বোয়ালিয়া গ্রাম, নওগাঁ সদর উপজেলা

তবে কৃষিশ্রমিকের সংকট আর আকাশে মেঘের আনাগোনার কারণে অনেক কৃষক ধান কাটা ও মাড়াই শেষ করা নিয়ে শঙ্কিত রয়েছেন। কারণ, গত বছর মৌসুমের শেষ দিকে ঝড়-বৃষ্টির কারণে বোরো ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল। এতে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ ধান কম পাওয়া যায়।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের নওগাঁ জেলা কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, জেলার ১১ উপজেলাতেই ইতিমধ্যে পুরোদমে ধান কাটা ও মাড়াই শুরু হয়ে হয়েছে। কৃষকের ঘরে ঘরে চলছে নতুন ধান তোলার উৎসব। চলতি বোরো মৌসুমে এই জেলায় ১ লাখ ৯০ হাজার ৯৫০ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। প্রতি হেক্টর জমিতে ৬ দশমিক ৫৭ মেট্রিক টন ধান এবং ৪ দশমিক ৩৮ মেট্রিক টন চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। সেই হিসাবে নওগাঁ জেলায় এই মৌসুমে ১২ লাখ ৫৪ হাজার ৫৪১ মেট্রিক টন ধান ও ৮ লাখ ৩৬ হাজার মেট্রিক টন চাল উৎপাদিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

স্থানীয় কৃষি কার্যালয় ও কৃষকদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, এবার প্রতি কেজি ধান উৎপাদনে খরচ পড়েছে ২৩ টাকা ৬০ পয়সা, যা গত বছর ছিল ১৭ টাকা ৮০ পয়সা। সার ও কীটনাশকের দাম এবং কৃষিশ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রতি কেজি ধান উৎপাদনে খরচ বেড়েছে ৫ টাকা ৮০ পয়সা।

সম্প্রতি নওগাঁ সদর উপজেলার হাসাইগাড়ী, দিঘলী ও গুমারদহ বিলের বিভিন্ন অংশে গিয়ে দেখা যায়, কিষান–কিষানিরা ধান কাটা, মাড়াই, বাড়িতে নিয়ে যাওয়া ও শুকানোর কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন।

নওগাঁ জেলার প্রধান ফসল ধান। এই ধানের ওপরেই বিশেষ করে কৃষক পরিবারগুলোর আয়–ব্যয়ের সবকিছু নির্ভর করে। কৃষকেরা জানান, সংসারের খরচ, ছেলেমেয়ের লেখাপড়া, সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানসহ আনুষঙ্গিক ব্যয়—সবই ধান বিক্রির টাকা দিয়ে করা হয়। এবার প্রতি বিঘায় ২২ থেকে ২৫ মণ করে ধানের ফলন হচ্ছে। গত বছর প্রতি বিঘায় ধানের ফলন হয়েছিল ১৮ থেকে ২০ মণ করে।

স্থানীয় হাটবাজারগুলোতে জিরাশাইল, কাটারিভোগ ও বিআর-২৮ জাতের ভেজা ধান উঠতে শুরু করেছে। এবার ধানের দাম গত বছরের এই সময়ের চেয়ে বেশি। এখন প্রতি মণ জিরা ধান ১ হাজার ১০০ থেকে ১ হাজার ২৭০ টাকায়, কাটারিভোগ ১ হাজার ১০০ থেকে ১ হাজার ৩০০ টাকায় ও বিআর-২৮ ধান ৯৫০ থেকে ১ হাজার ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গত বছর এই সময়ে প্রতি মণ জিরা ১ হাজার ৫০ টাকা, কাটারিভোগ ১ হাজার ১০০ টাকা ও বিআর-২৮ ধান ৮৫০ টাকা দামে বিক্রি হয়েছিল।

সম্প্রতি সদর উপজেলার বোয়ালিয়া গ্রামের মাঠে আনসার আলী নামের এক কৃষক এবার ২০ বিঘা জমিতে বোরো চাষের তথ্য জানিয়ে বলেন, ‘বিঘাপ্রতি ২০ থেকে ২৫ মণ করে ধানের ফলন হচ্ছে। পর্যাপ্ত কামলা না পাওয়ার কারণে ধান কাটা-মাড়াই কিছুটা ধীরে হছে। বাইরের জেলা থেকে এলাকায় এবার খুব কম কামলা আসিছে। তাই ধান কাটা কামলা লিয়ে গেরস্তরা টানাটানি করোছে।’

নিয়ামতপুর উপজেলার ছাতড়া গ্রামের কৃষক রাজু আহমেদ বলেন, মাঠে ধান পেকে গেছে। কিন্তু শ্রমিকের অভাবে ধান কাটা যাচ্ছে না। পাকা ধান নিয়ে এলাকার কৃষকেরা বেশ বিপাকে পড়েছেন। কারণ, এখানকার কৃষকদের প্রায় সব ধান আবাদ হয়ে থাকে বিলের জমিতে। কিছুদিন ধরে আকাশে মেঘের আনাগোনা দেখে শঙ্কিত হয়ে পড়ছেন তাঁরা। কারণ, বিলগুলো নিচু হওয়ায় সামান্য বৃষ্টিতেই বিলের ধান ডুবে যায়।

কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী নওগাঁয় চলতি বোরো মৌসুমে কৃষিশ্রমিকের চাহিদা ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৫১ হাজার ৮৭৫ জন। স্থানীয়ভাবে ৩ লাখ ৪৬ হাজার ১৮৫ জন কৃষিশ্রমিকের জোগান আসার কথা। বাইরের বিভিন্ন জেলা থেকে বাকি ১ লাখ ৫ হাজার ৬৯০ জন কৃষিশ্রমিক আসবেন, এমনটাই ভাবা হয়েছিল। কিন্তু সে রকম আসেননি বলে জানান কৃষকেরা।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর নওগাঁর উপপরিচালক আবুল কালাম আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, এবার প্রতি হেক্টরে ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৬ দশমিক ৫৭ মেট্রিক টন। তবে ফলন দেখে মনে হচ্ছে, উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রাও ছাড়িয়ে যেতে পারে। কিছু এলাকায় শ্রমিকসংকটের কথা শোনা যাচ্ছে। ধান কাটার এখনো প্রচুর সময় রয়েছে। চলতি মে মাসের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত চলবে। ইতিমধ্যে বাইরের জেলা থেকে কৃষিশ্রমিকেরা আসতে শুরু করেছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *