ঢাকায় বড় ভূমিকম্প নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মত

ঢাকায় বড় ভূমিকম্প নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মত

ঢাকার ভূমিকম্প নিয়ে বিশেষজ্ঞদের দুই ধরনের মত পাওয়া গেছে। তাদের একটি অংশ মনে করেন, ঢাকায় বড় ভূমিকম্পের শঙ্কা রয়েছে। আবার কোনও কোনও বিশেষজ্ঞ বলছেন ঠিক উল্টো—অর্থাৎ এ ধরনের কোনও আশঙ্কা নেই। তবে দুপক্ষই আতঙ্কিত না হয়ে সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। তারা বলছেন, প্রাণ বাঁচাতে সচেতন হওয়ার কোনও বিকল্প নেই।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী জানান, গত ১০০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশে তেমন বড় ভূমিকম্প হয়নি। তবে প্রায় ১৩৫ বছরের এক হিসাব ধরলে ৭ মাত্রার একটা ভূমিকম্প বাংলাদেশে হতেও পারে।

অন্যদিকে বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদফতরের (জিএসবি) সাবেক পরিচালক ফজলুল করিম আজাদ মনে করেন, বাংলাদেশ বিশ্বের সক্রিয় ভূমিকম্প অঞ্চলে অবস্থিত হলেও দূরের কোনও ফল্টের কারণে ঢাকা শহরে বড় ধরনের কোনও ক্ষয়ক্ষতি হবে না। ফলে আতঙ্কিত হওয়ার মতো কিছু নেই।

শুক্রবার (৫ মে) ভোর ৫টা ৫৭ মিনিটে রাজধানী ঢাকাসহ এর আশপাশের কয়েকটি জেলায় মৃদু ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। এতে তাৎক্ষণিকভাবে কোনও ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই ভূমিকম্প নিয়ে চলছে নানা আলোচনা।

মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ইউএসজিএস জানায়, শুক্রবার ভোরের ভূমিকম্পটির মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে ৪ দশমিক ৩। এর উৎপত্তিস্থল ছিল রাজধানী ঢাকা থেকে প্রায় ৪২ কিলোমিটার দূরে দোহারে। আর ভূপৃষ্ঠ থেকে গভীরতা ছিল ১০ কিলোমিটার।

এর আগে গত ৩০ এপ্রিল দুপুরে চট্টগ্রামে ৪ দশমিক ৬ মাত্রার ভূকম্পন অনুভূত হয়। যেটির উৎপত্তিস্থল ছিল মিয়ানমারের মাউলাইকে। গত ২৫ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের তারাবো এলাকায় সংঘটিত ভূমিকম্প রেকর্ড করা হয় ৩ দশমিক ৯ মাত্রা।

আবহাওয়া অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ৫৭ বার ভূমিকম্প হয়েছে বাংলাদেশে। এরপর চলতি বছর টেকনাফ, কক্সবাজার ও নারায়ণগঞ্জে এবং সর্বশেষ আজ সকালে দোহারে ভূমিকম্প অনুভূত হয়। এতে কেঁপে ওঠে ঢাকা শহর। আর এই কম্পনকে বড় ধরনের ভূমিকম্পের ইঙ্গিত বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

বিশেষজ্ঞরা কী ভাবছেন
বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, গত ১০০ বছরের মধ্যে আমাদের দেশে তেমন বড় ভূমিকম্প হয়নি, এটা একটা আশঙ্কার বিষয়। কিন্তু ৭ মাত্রার ভূমিকম্পের একটা আশঙ্কার মধ্যে আছি আমরা। ভূমিকম্পের সোর্স আছে মোট পাঁচটি। এর মধ্যে ১৮৬৯ সালে একটা ভূমিকম্প হয়েছে, ১৮৮৫ সালে একটা, ১৯৩০ একটা, অন্যটা ঘটেছিল ১৯৩৮ সালে। ১৯৩০ বা ১৯৩৮ সালে ১০০ বছর হয়নি। আর ১৮৮৫ সালে যমুনা সেতুর কাছে শেরপুরে যে ভূমিকম্প হয়েছিল, তা প্রায় ১৩৫ বছর আগে। ১৮৮৫ সাল হিসাবে ধরলেও ৭ মাত্রার একটা ভূমিকম্প বাংলাদেশে হতেও পারে।

আনসারী বলেন, এদিকে প্লেট বাউন্ডারি ওয়ান অবস্থিত কক্সবাজারে, প্লেট বাউন্ডারি টু কুমিল্লার দিকে আর আসামের দিকে যেটা চলে গেছে, সেটা প্লেট বাউন্ডারি থ্রি। সব উৎসই ঢাকার আশপাশে। ফলে ঢাকার ১০০ থেকে ২০০ কিলোমিটারের মধ্যে ভূমিকম্প হলে ঢাকায় কিছুই থাকবে না।

জিএসবির সাবেক পরিচালক ফজলুল করিম আজাদ বলেন, বাংলাদেশ বিশ্বের সক্রিয় ভূমিকম্প অঞ্চলে অবস্থিত। বাংলাদেশের আশপাশে বড় ভূমিকম্প সংঘটিত হওয়ার ভূগাঠনিক অবস্থা বিরাজমান। এর মধ্যে সবচেয়ে কাছাকাছি ভূগাঠনিক অবস্থা আছে শিলং নাসিফ (মাটির ভেতর থেকে ওপরে উঠে আসা কোনও উঁচু সমতল ভূমি বা উপত্যকার মতো) বা শিলং প্লেটের উত্তর ও দক্ষিণে বড় আকারের ফাটল বা জিওলজিক্যাল ফল্ট (ভূতাত্ত্বিক চ্যুতি) আছে। দক্ষিণের চ্যুতিটি ৩০০ কিলোমিটারের বেশি দৈর্ঘ্যের, যা ডাউকি ফল্ট নামে পরিচিত।

তিনি বলেন, উত্তরের ফল্টটি ভারতের ব্রহ্মপুত্র নদের সমান্তরালে একটু বড় ফাটল, যা ভূমির ওপর থেকে খুব একটা স্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হয় না। এই ফল্টের কারণে ১৮৯৭ সালে সেখানে বড় মাত্রার একটি ভূমিকম্প হয়েছিল। এতে ময়মনসিংহের মুক্তাগাছায় বেশ ক্ষয়ক্ষতি হলেও ঢাকার চকবাজারের একটি মসজিদের শুধু মিনারে ফাটল দেখা দিয়েছিল।

ফজলুল করিম আজাদ আরও বলেন, এখনকার মতো তখন হাইরাইজ বিল্ডিং না থাকলেও লালবাগ কেল্লা, আহসান মঞ্জিলসহ বেশ কিছু ঐতিহাসিক স্থাপনা ছিল, সেগুলার কোনও ক্ষতি হয়নি। দূরের কোনও ফল্টের কারণে ঢাকা শহরে বড় ধরনের কোনও ক্ষয়ক্ষতি হবে না। সম্প্রতি তুরস্কের ভূমিকম্পের পর অনেকেই বলতে শুরু করেন, ঢাকায় বড় ভূমিকম্প হতে পারে। এমনভাবে বলা হচ্ছে, তাতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে। এতটা আতঙ্কিত হওয়ার মতো কিছু নেই।

করণীয় কী
অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী বলেন, দেশের বহুতল ভবনগুলোকে ভূমিকম্প-সহনশীল করতে হবে। সেটা করার মতো কারিগরি দক্ষতা ও সামর্থ্য বাংলাদেশের আছে। তবে এ জন্য সরকারের জরুরি উদ্যোগ দরকার। সারা দেশে বড় বড় শহরে সিটি করপোরেশনের মাধ্যমে সেখানকার বাসাবাড়ি ভূকম্পন-সহনীয় কি না, সেটা যাচাই করতে হবে। কোনও বাসায় সমস্যা পেলে তা মজবুত করার ব্যবস্থা করতে হবে।

এ বিষয়ে স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল এবার দোহারে এসে হাজির হয়েছে। একেবারে ঘরের দুয়ারে চলে এসেছে। এর তীব্রতা কম ছিল, কিন্তু মাত্রা বেশি ছিল। এ কারণে ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। এরপরও যদি আমরা সতর্ক না হই, তাহলে আর কিছু করার নেই। ভবনগুলো চেক করার কোনও ব্যবস্থা নেই। হাসপাতালগুলোয় যে চিকিৎসা পাবেন, তারও নিশ্চয়তা নেই। খোলা কোনও জায়গা নেই, যেখানে গিয়ে মানুষ জড়ো হতে পারবে। গ্যাসের লাইনগুলোর যে অবস্থা, বড় কোনও ভূমিকম্প হলে আগুন লেগেই অনেক মানুষ মারা যেতে পারে।

তিনি বলেন, আমাদের চরম সচেতনতার অভাব রয়েছে। আমরা জানিই না কী করতে হবে। তবে এই মুহূর্তে ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ আমাদের রয়েছে। প্রতিটি ভবন পরীক্ষা করে নিরাপদ-অনিরাপদ ঘোষণা করার সময় হয়েছে। সরকার যদি উদ্যোগ না নেয়, তাহলে আমরা ঘুরে দাঁড়াতে পারবো না। নিজেদের সচেতনতা ও সরকারি উদ্যোগ এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি জরুরি।

ফায়ার সার্ভিসের নির্দেশনা
ভূমিকম্প হলে প্রাণ বাঁচাতে এবং আতঙ্কিত না হয়ে সচেতন হওয়ার জন্য ফায়ার সার্ভিস কয়েকটি নির্দেশনা দিয়েছে। সেগুলো হলো:

১. ভূ-কম্পন অনুভূত হলে শান্ত থাকুন। যদি ভবনের নিচতলায় থাকেন, তাহলে দ্রুত বাইরে খোলা জায়গায় বেরিয়ে আসুন।

২. যদি ভবনের ওপর তলায় থাকেন, তাহলে কক্ষের নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিন।

৩. ভূমিকম্পের সময় বিছানায় থাকলে বালিশ দিয়ে মাথা ঢেকে নিন। অথবা টেবিল, ডেস্ক বা শক্ত কোনও আসবাবের নিচে আশ্রয় নিয়ে তা এমনভাবে ধরে থাকুন, যেন মাথার ওপর থেকে সরে না যায়। এ ছাড়া শক্ত দরজার চৌকাঠের নিচে ও পিলারের পাশে আশ্রয় নিতে পারেন।

৪. উঁচু বাড়ির জানালা, বারান্দা বা ছাদ থেকে লাফ দেবেন না।

৫. ভূমিকম্পের প্রথম ঝাঁকুনির পর ফের ঝাঁকুনি হতে পারে। সুতরাং একবার বাইরে বেরিয়ে এলে নিরাপদ অবস্থা ফিরে না আসা পর্যন্ত ভবনে প্রবেশ করবেন না।

৬. রান্নাঘরে থাকলে যত দ্রুত সম্ভব বের হয়ে আসুন। সম্ভব হলে বাড়ির বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মেইন সুইচ বন্ধ করুন।

৭. মোবাইল বা ফোন ব্যবহারের সুযোগ থাকলে উদ্ধারকারীদের আপনার অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করুন।

৮. দুর্ঘটনার সময় লিফট ব্যবহার করবেন না।

৯. যদি কোনও বিধ্বস্ত ভবনে আটকা পড়েন এবং আপনার ডাক উদ্ধারকারীরা শুনতে না পায়, তাহলে বাঁশি বাজিয়ে অথবা হাতুড়ি বা শক্ত কোনও কিছু দিয়ে দেয়ালে বা ফ্লোরে জোরে জোরে আঘাত করে উদ্ধারকারীদের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করুন।

১০. ঘরের বাইরে থাকলে গাছ, উঁচু বাড়ি, বিদ্যুতের খুঁটি থেকে দূরে থাকুন।

১১. গাড়িতে থাকলে ফুটওভার ব্রিজ, ফ্লাইওভার, গাছ ও বিদ্যুতের খুঁটি থেকে দূরে গাড়ি থামান। ভূ-কম্পন না থামা পর্যন্ত গাড়ির ভেতরেই থাকুন।

১২. ভাঙা দেয়ালের নিচে চাপা পড়লে বেশি নড়াচড়ার চেষ্টা করবেন না। কাপড় দিয়ে মুখ ঢেকে রাখুন এবং উদ্ধারকারীদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *