চিত্ত আমার গল্প

চিত্ত আমার গল্প

ট্রানজিট অবধি আশপাশের বুভুক্ষু লোকগুলোর গায়ের গন্ধ তোমার চেনা, সস্তা সেন্টের ঘামচাপা ঘ্রাণ, পান-সুপারি-জর্দার গন্ধ, মাফলার আর সোয়েটারের পশমি গন্ধ। এর পরের পথটুকুতে তোমার চারপাশের লোকদের গায়ের গন্ধ পাল্টে গেল। নিশ্বাসের গন্ধ, হেগো পাজামার গন্ধ, বিদেশ-বিদেশ সাবানের গন্ধ। তোমার গলায়, তোমার কাঁধে, তোমার কাঁখে চেপে বসেছে সিটবেল্ট, তোমার জেদের মতোই দৃঢ়। জানালায় উজ্জ্বল নীল আকাশ দেখলে না, কোদালি মেঘের তলায় হাজার হাজার ফুট নিচে তিরপলের মতো ভাঁজ ভাঁজ পর্বতমালা দেখলে না। তোমার ফ্যাকাশে মুখের দিকে তাকিয়ে করুণা হলো লোকের, তোমাকে ইউনিভার্সিটি অব নটিংহ্যামের এক অধ্যাপক ছোট্ট একটা কাগজের মোড়কে আদা লজেন্স দিল, মনে আছে? আদার মোরব্বার মতো খেতে।

উড়োজাহাজ মানে এক মহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশে যাওয়ার সময় তোমার চারদিকে ফিনকি দিয়ে পড়ছে অ্যামনিয়টিক ফ্লুইডের মতন অশ্রু। জানতে? অ্যামনিয়টিক ফ্লুইডের নামটা ছাড়া আর কিছু তুমি জানতে না তখনো। ওই রুপালি উড়োজাহাজ বার্থক্যানেলের মতোই একটা টানেল যেন—একবার এপাশে এলে আর ফিরে যাওয়া যায় না আগেকার সেই প্রাণদায়িনী ম্যাট্রিক্সে। অথচ তুমি ভেবেছিলে সেদ্ধ ঢ্যাঁড়স কিংবা কচুর লতির মতন হিলহিলিয়ে পিছলে বের হয়ে যাবে টানেল দিয়ে, একটা জীবন থেকে আরেকটা জীবনে। ভেবেছিলে। প্রিয় সবজিরা তোমাকে কিছুই শেখায়নি, এমনকি আর হতে পারে!
হজম না করে উগরে দিল তোমাকে উড়োজাহাজটা। মনে আছে, খুব ছোটবেলায় আলনার আড়ালে লুকিয়ে থাকতে তুমি, ক্রনিকল অব নার্নিয়ার সেই অন্তহীন ওয়ার্ডরোবের ভেতর দিয়ে হেঁটে হেঁটে তুমিও চলে যাবে একদিন আরেক দেশে। ভেবেছিলে।

এই উড়োজাহাজ-যাত্রা তোমাকে আরও দীর্ঘদিন ভোগাবে, তোমাকে প্রতিবছর কোনো না কোনো সময় পরিজনদের দেখার আশায় হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিতেই হবে—এমনটা তোমাকে লোকে বুঝিয়ে বলেছিল মনে আছে? তাই তুমি একদিন উড়োজাহাজের সঙ্গে সন্ধি করে বসলে। ওই ত্রিশঙ্কু দশার সময়টুকু তুমি কিছু ইন্দ্রিয়বিলাসে কাটাবে। সময় কাটাতে পারার জন্য অখণ্ড সময় তুমি কবেই-বা পেয়েছিলে—অতএব ওটা তোমার একরকম ছুটি। রান্না করার ঝক্কি নেই, খাবার এসে যাবে—যদিও আগুন-গরম অথবা ঠান্ডা-ড্যাবড্যাবে। পড়ার সময় আছে, লেখার উপায় আছে, সিনেমা দেখার বা গান শোনার ব্যবস্থা আছে। সবাই ঘুমিয়ে পড়লে শ্রীকান্তের শ্মশানবাসের মতন অভিজ্ঞতা হওয়ার সম্ভাবনাও আছে। এত আয়োজনে দেহপাত করতে পারবে না? ভেবে দ্যাখো, এই সাষ্টাঙ্গ নিবেদন তুমি বিপদকে বরাবর করেছ, স্কুলজীবনে ক্যালকুলাসের কাছে করেছ, পদার্থবিদ্যা পড়তে গিয়ে করেছ। বিয়ের বেলায়ও করেছ। ভূমিকম্প হলে যেমন মাটিতে মিশে শুয়ে পড়তে হয় ও রকম…দুরূহ যেকোনো বিষয়ের সামনাসামনি হলেই তুমি আশিরপদনখ সারেন্ডার করেছ, যেন নাৎসিদের কাছে প্যারিস গছিয়ে দিয়ে প্যারিস বাঁচানোর মতন ব্যাপার সেটা। কিন্তু কোনো কোনো নরকযাত্রা আপাদমস্তক জীবনের নিবেদন দিয়েও কুলানো যায় না। তাই না? আসলেই করেছিলে আত্মসমর্পণ? কখনো? আত্মা আড় হয়ে থাকত না তোমার?

মানুষ যে উড়তে জানে, যেকোনো পরিযায়ী পাখির চেয়ে বেশি দূরত্বেই সে উড়ে যেতে পারে যন্ত্রে চেপে, উড়ালকে সে স্বপ্ন থেকে বাস্তবের বস্তুতে পরিণত করেছে, এক শতকে সেসব জলভাত হয়ে এসেছে। তোমার কাছে জলভাত হতে পায়নি সে তোমার খামতি। ওড়ার ধকল কাটিয়ে উঠে তুমি একদিন শুয়ে পড়লে। ঘাসে। দক্ষিণ এশীয় মেয়ে, শহরের নাগরিক, জানো না তো ঘাসের সুড়সুড়ি কেমন লাগে সারা গায়ে। বহু দূরে টালির ছাদ দেওয়া বেঞ্চিঘরে বসে একদল কালো মানুষ জেম্বে ড্রাম বাজাচ্ছে আর তোমার মৃদঙ্গ মাটির দেহ কাঁপছে, ‘মৃৎ অঙ্গ যাহার’। অঁরি রুশোর তুলিতে পশ্চিমের মেঘে আঁকা সেদিন বিষাদের রং, যা গোধূলিবেলায় মানুষের হৃদয়ে জীবিত বোধকে জড়তে পরিণত করে ফেলে। বুকচাপা ঘাসের নিচে থরথর কাঁপছে পাতাল, রেল চলেছে পাতালের গহ্বর দিয়ে, বলে চলেছে—জানি না। জানি না। জানতে হবে। জানি না।

মাটিতে শুয়ে আবার আকাশ। পত্রীমশাই যেমন আকাশের জন্য লিখেছিলেন—

‘মাঝে মাঝে লোডশেডিং হোক।

আকাশে জ্বলুক শুধু ঈশ্বরের সাতকোটি চোখ

বাকী সব আলকাতরা মাখুক।’

তেমন মিটমিটে তারা জ্বলা আকাশ, সিটবেল্ট বাঁধা কালপুরুষ। আরও দূরে জেগে আছে নির্মাণাধীন হাইরাইজের ওপর দিয়ে ক্রেনের লাল লাল চোখ। এক আকাশ থেকে আরেক আকাশের মাঝখানে কোথাও আলো-আঁধারির আন্তর্জাতিক তারিখরেখা। আকাশের ওপারে লাইকা কুকুর তোমার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছে, আকাশযানে চড়ার একরকম গভীর-স্থাবর এবং স্থায়ী বেদনা আছে, ওটা তুমি জানো আর জানত লাইকা। নিচে, অনেক নিচে কালো মানুষের হাতে তখনো দ্রিমি দ্রিমি বাজছে চামড়ার যন্ত্র। সন্ধ্যার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ তোমার চোখে পড়ল প্লেনের যাতায়াতের পথ, প্রতিদিন সে পথ ধরে কত প্লেন ওড়ে। চিত হয়ে শুয়ে থাকতে থাকতে তুমি কত-কী ভাবলে—ওইটুকু তুমি একসময় আধুলি খুঁজতে ফোনবুথে গুঁজে দেবে বলে তারপর একদিন মুঠোয় ধরলে ধড়ফড়ে ফোন। ম্রিয়মাণ আধুলির মতো চাঁদ উঠেছে আকাশে, যে শহরে বিজলির আলো চলে যায় না, সে শহরে চাঁদ বড় দরিদ্র। এক জীবনে এমন সময় থেকে উড়ে এসেছ তুমি, যেখানে আশীর্বাদক লোকে সত্যিই বলত, ‘রাজরানি হও, মা’, গুরুজনেরা সামান্য টাকা হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলত, ‘মিষ্টি কিনে খেয়ো’। তারপর ওরা হারিয়ে গেল বরফযুগের প্রাণীর মতো। মনে ভাবলে, তোমার উড়ালটা টাইমট্রাভেল যেন—হায় যান্ত্রিক পরিবহন, তার উড়াল অমন নয়, সে তো সময়ে বাঁধা, সময়ের বন্ধনীতে বাঁধা। যে সময়ে আর চাইলেই যাওয়া যায় না, যন্ত্র কিংবা যান সে সময়ে যেতে পারে না; অথচ সে সময়টায় টুক করে ডুব দিয়ে এসে তুমি আবার এ সময়ে ফিরে আসতে পারো, যেন তুমি কোত্থাও যাওনি। তুমি তবে উড়োজাহাজতর।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *