ঘূর্ণিঝড় মোখার প্রভাবে কক্সবাজার সাগর উপকূল উত্তাল

ঘূর্ণিঝড় মোখার প্রভাবে কক্সবাজার সাগর উপকূল উত্তাল

বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় মোখার প্রভাবে কক্সবাজার সাগর উপকূল বেশ উত্তাল হয়ে উঠেছে। আজ রোববার সকাল থেকে বৃষ্টির সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়া বইতে শুরু করেছে। সকাল নয়টার দিকে বাতাসের গতি আবার বাড়ছে। তাতে জলোচ্ছ্বাসের আতঙ্কে ভুগছেন উপকূলের লাখো মানুষ। সবচেয়ে বেশি আতঙ্কে সেন্ট মার্টিন দ্বীপ, সাগরদ্বীপ কুতুবদিয়া ও টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপের মানুষ।

সেন্ট মার্টিন দ্বীপের মধ্যভাগে সরকারি হাসপাতালে একটি ভবনে গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় পরিবারের পাঁচজনকে নিয়ে আশ্রয় নেন দ্বীপের গলাচিপা এলাকার জেলে সব্বির আহমদ। কেন্দ্রের একটি কক্ষে নির্ঘুম রাত কাটান তিনিসহ অন্তত ৫০ জন। আজ সকালে পরিবারের সদস্যদের হাসপাতাল কেন্দ্রে রেখে ঘরে ফেরেন সব্বির। ঘটনাস্থল থেকে তিনি মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, গতকাল দিবাগত রাত সাড়ে তিনটার দিকে সেন্ট মার্টিনে হালকা বৃষ্টি ও দমকা হাওয়া বইছিল। আজ সকাল থেকে সাগর উত্তাল দেখালেও ঝড়বৃষ্টি নেই। তবু জলোচ্ছ্বাসের আতঙ্কে আছেন দ্বীপের মানুষ।

সকাল নয়টায় সেন্ট মার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সেখানকার পরিস্থিতি খুব একটা অস্বাভাবিক হয়নি। সকালে হালকা বৃষ্টি ও দমকা হাওয়া বইলেও সাড়ে আটটার দিকে তা–ও বন্ধ হয়েছে। তবে সাগর প্রচণ্ড উত্তাল রয়েছে। গতকাল রাতে দ্বীপের বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্র ও ৪০টির বেশি হোটেলে আশ্রয় নেওয়া প্রায় ছয় হাজার বাসিন্দার মধ্য থেকে অন্তত দুই হাজার লোকজন বাড়িতে ফিরেছেন প্রয়োজনীয় কাজ সামলাতে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোয় বিদ্যুৎ, পানির সরবরাহ ও শৌচাগারের সুবিধা না থাকায় কিছু নারী ঘরে ফিরছেন। ঘূর্ণিঝড়ের অবস্থা দেখে তাঁরা দ্রুত কেন্দ্রে ফিরে আসবেন। আশ্রয়কেন্দ্রে গতকাল রাত থেকে শুকনা খাবার ও পানি সরবরাহ করা হচ্ছে।

বঙ্গোপসাগরের মধ্যে আট বর্গকিলোমিটার আয়তনের প্রবালসমৃদ্ধ দ্বীপ সেন্ট মার্টিনের লোকসংখ্যা ১০ হাজার ৭০০। এর মধ্যে এক হাজার মানুষ আগেই দ্বীপ থেকে টেকনাফে পাড়ি জমিয়েছেন।

সেন্ট মার্টিনের সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ফিরোজ আহমদ খান বলেন, গত বছরে ২৫ অক্টোবরে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের জলোচ্ছ্বাসে সেন্ট মার্টিন দ্বীপ তলিয়ে গিয়েছিল। এ সময় শতাধিক ঘরবাড়ি ও বিপুল নারকেলগাছ উপড়ে পড়েছিল। ঘূর্ণিঝড় মোখা আঘাতের সময় সাগরে পূর্ণিমা ও অমাবস্যার জোয়ারের প্রভাব থাকতে পারে। তখন জোয়ারের পানির উচ্চতা স্বাভাবিকের চেয়ে ২০ থেকে ২৫ ফুট বেশি হতে পারে। তখন ক্ষয়ক্ষতিও বাড়তে পারে। জলোচ্ছ্বাস ঠেকানোর মতো টেকসই বেড়িবাঁধ সেন্ট মার্টিনে নেই।

আশ্রয়কেন্দ্রে নির্ঘুম রাত মানুষের

ঘূর্ণিঝড় মোখা নিয়ে আতঙ্কে সাগরদ্বীপ উপজেলা কুতুবদিয়ার দেড় লাখ মানুষ। দ্বীপের চারদিকে বেড়িবাঁধ আছে ৪০ কিলোমিটার। ২০ থেকে ২৫ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাস হলে দ্বীপের শত শত ঘরবাড়ি তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন এলাকার মানুষ।
জলোচ্ছ্বাসের শঙ্কায় গতকাল সন্ধ্যায় উপজেলার পশ্চিম তাবলেরচর গণস্বাস্থ্য ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রে ওঠেন দ্বীপের প্রায় ৬০০ জন। এর বেশির ভাগ নারী ও শিশু। পাশের আলী আকবর ডেইল উচ্চবিদ্যালয়ে ওঠেন আরও ৯৭০ জন এবং কবি জসীমউদ্‌দীন উচ্চবিদ্যালয়ে ওঠেন প্রায় ৫০০ জন। অধিকাংশ মানুষের রাত কেটেছে জলোচ্ছ্বাসের আতঙ্কে।

কবি জসীমউদ্‌দীন উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে আশ্রয় নেওয়া স্থানীয় নারী শামছুন্নাহার (৬৫) বলেন, বাড়ির সামনে বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্র, তারপর সমুদ্র। ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের ঘূর্ণিঝড়ে তিনি পরিবারের সাতজনকে হারিয়েছিলেন। ঘূর্ণিঝড় মোখাতে তিনি কাউকে হারাতে চান না। তাই ঘরবাড়ি ফেলে আশ্রয়শিবিরে আসেন।

ঝড়ো হাওয়ায় উত্তাল সাগর। আজ সকাল সাড়ে ১০টার দিকে টেকনাফ সমুদ্র সৈকতেছবি: সাজিদ হোসেন

কুতুবদিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ফরিদুল ইসলাম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, আজ সকাল থেকে দমকা হাওয়ার সঙ্গে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির পাশাপাশি সমুদ্র উত্তাল রয়েছে। দ্বীপের চারদিকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধও ঠিক রয়েছে। তবু জলোচ্ছ্বাসের আতঙ্ক মানুষের মনে। জলোচ্ছ্বাস শঙ্কায় গতকাল রাতেই কুতুবদিয়ার ৯২টি আশ্রয়কেন্দ্রে ৮৪ হাজার ৯৭৫ জনকে সরিয়ে আনা হয়েছে।

টেকনাফ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নুরুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, গতকাল রাতে উপজেলার ৫৯টি আশ্রয়কেন্দ্রে সরিয়ে আনা হয়েছে প্রায় ২৫ হাজার মানুষকে। আশ্রয়কেন্দ্রে মানুষের নির্ঘুম রাত কেটেছে। আজ বিকেলের মধ্যে ঘূর্ণিঝড় মোখা টেকনাফ উপকূলে আঘাত হানার কথা। দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রস্তুতি রয়েছে। শাহপরীর দ্বীপে বেড়িবাঁধের বাইরে থাকা কয়েক হাজার মানুষকে সরিয়ে আনা হয়েছে।

কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান প্রথম আলোকে বলেন, গতকাল রাতের মধ্যে সেন্ট মার্টিনের প্রায় ছয় হাজার, কুতুবদিয়াতে ৮৪ হাজার, মহেশখালীতে ১৬ হাজার, টেকনাফে ২৫ হাজার মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে সরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি রোধে জেলা প্রশাসনের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক দলের নেতারা মাঠে তৎপর।

কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র মুজিবুর রহমান বলেন, শহরের ২৩টি আশ্রয়কেন্দ্রে ৩০ হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। বেশির ভাগ এসেছেন পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ড নাজিরারটেক, কুতুবদিয়াপাড়া ও সমিতিপাড়া উপকূল থেকে। তাঁদের রান্না করা খাবার ও শুকনা খাবার, পানির বোতল ও স্যালাইন সরবরাহ করা হচ্ছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *