ক্যানসার চিকিৎসায় রোগীদের দুর্ভোগ, ১৭টি যন্ত্রের মধ্যে ১১টিই অকেজো

ক্যানসার চিকিৎসায় রোগীদের দুর্ভোগ, ১৭টি যন্ত্রের মধ্যে ১১টিই অকেজো

ক্যানসার চিকিৎসায় রোগীদের দুর্ভোগ ও ব্যয় দুটোই বেড়েছে। সারাদেশে ৯টি সরকারি হাসপাতালে ক্যানসার চিকিৎসার গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি রেডিওথেরাপির ১৭টি যন্ত্র রয়েছে। তার মধ্যে ১১টিই অকেজো। ঢাকার জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সবগুলো মেশিনই নষ্ট। নোটিশ টানিয়ে তা বলা আছে। কবে নাগাদ এসব মেশিন সচল হবে তার উত্তর নেই কারও কাছে। এর ফলে বেশির ভাগ রোগীকে বেসরকারি হাসপাতালে গিয়ে বিপুল ব্যয়ে এই চিকিৎসা নিতে হচ্ছে। দরিদ্র রোগীদের পক্ষে এই ব্যয়ভার বহন করা সম্ভব হচ্ছে না।

চিকিৎসকরা বলছেন, প্রাণঘাতী এই রোগের চিকিৎসায় প্রায় ৮০ শতাংশ রোগীর রেডিওথেরাপির দরকার হয়। একজন ক্যানসার রোগীর চিকিৎসা ব্যয় বছরে ৬ থেকে ১০ লাখ টাকা, যা সরকারি হাসপাতালের তুলনায় ৮-১০ গুণ। তাতে নিঃস্ব হচ্ছেন অনেকেই।

জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, দেশে ক্যানসার আক্রান্তদের রেডিওথেরাপি দেওয়া হয় মূলত দুই ধরনের মেশিনে। একটি কোবাল্ট, অন্যটি লিনিয়ার। সরকারি হাসপাতালে নতুন কোবাল্ট মেশিনে দিনে ২০০ জন রোগীকে থেরাপি দেওয়া যায়। লিনিয়ার মেশিনে দিনে থেরাপি দেওয়া যায় অন্তত ১০০ জনকে। সরকারি হাসপাতালে কোবাল্ট মেশিনে রেডিওথেরাপির জনপ্রতি খরচ ১০০ টাকা। এর সঙ্গে জনপ্রতি প্ল্যানিং খরচ এক হাজার ৫০০ টাকা। লিনিয়ার মেশিনে খরচ হয় ২০০ টাকা। এর সঙ্গে প্ল্যানিং খরচ এক হাজার ৫০০ টাকা।

অন্যদিকে একটি বেসরকারি ক্যানসার হাসপাতালে লিনিয়ার মেশিনে বর্তমানে জনপ্রতি রেডিওথেরাপির খরচ সাড়ে চার হাজার থেকে আট হাজার টাকা। এর সঙ্গে প্ল্যানিং খরচ ৫০ হাজার থেকে ৮০ হাজার টাকা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বর্তমানে ক্যানসার চিকিৎসা চলা ৯টি সরকারি হাসপাতালের মধ্যে কয়েকটিতে একটি করে পাঁচটি রেডিওথেরাপি যন্ত্র সচল রয়েছে। সেগুলো হচ্ছে  ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল।

অকেজো ১১টি রেডিওথেরাপি যন্ত্রের মধ্যে ক্যানসার হাসপাতালেই রয়েছে ছয়টি। এ ছাড়া ঢাকা মেডিক্যালে দুটি, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ ও রংপুর মেডিক্যালে একটি করে অকেজো মেশিন রয়েছে।

ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ক্যানসার বিভাগের কোবাল্ট ৬০ রেডিওথেরাপি মেশিন গত ২০১৫ সাল থেকে নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। এই তথ্য নিশ্চিত করে হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত উপপরিচালক ডা. জাকিউল ইসলাম জানান, হাসপাতালটিতে পূর্ণাঙ্গ ক্যানসার বিভাগের জন্য নতুন ভবনের কাজ চলছে। কাজ শেষ হলে আধুনিক প্রযুক্তির রেডিওথেরাপি দেওয়ার জন্য লিনিয়ার এক্সেলেটর মেশিন বসানো হবে। এ বিষয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তৎপর আছে বলেও জানান তিনি।

চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের (চমেক) রেডিওথেরাপি বিভাগের রেজিস্ট্রার ডা. নাছির উদ্দিন মাহমুদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ২০২২ সালের জুন থেকে নষ্ট জরায়ুর ক্যানসার থেরাপির একমাত্র মেশিন ব্র্যাকি থেরাপি। তবে ক্যানসার রোগীদের অন্য মেশিন রেডিওথেরাপিসহ বাকি মেশিন সচল আছে। এ মেশিনটির ত্রুটি সারানোর জন্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি লেখা হয়েছে।

জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. নাজমুল হক জানান, হাসপাতালে লোকবলের সংকট আছে। আর রেডিওথেরাপি মেশিন রক্ষণাবেক্ষণের মতো জনবল নেই।

এই হাসপাতালে দীর্ঘদিন কাজ করে গত ডিসেম্বরে অবসরে গেছেন ক্যানসার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক হাবিবুল্লাহ তালুকদার। বর্তমানে তিনি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ক্যানসার রোগতত্ত্ব, প্রতিরোধ ও গবেষণা কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ক্যানসার ইন্সটিটিউটে রেডিওথেরাপির ছয়টি মেশিন আর ঢাকার বাইরে নয়টি মেডিক্যাল কলেজের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ঢাকার বাইরেরগুলো সবসময় চালু থাকতো না, যার কারণে রোগীদের প্রচুর ভিড় হতো। অনেক রোগীকে ৫-৬ মাস অপেক্ষায় থাকতে হতো। বেশ কয়েক বছরে ক্যানসার ইন্সটিটিউটের মেশিন অচল হয়ে গেছে। যার কারণে একটি ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘এই মেশিনগুলো কেনার পর বানাতে এক বছর সময় পার হয়ে যায়। এখন সবগুলো মেশিন নষ্ট হয়ে গেলে কী উপায় হবে। এই যে হঠাৎ শূন্যতা তৈরি হয়েছে এটি দীর্ঘদিনের ব্যর্থতা বলা যায়। এই মেশিনগুলোর হাফ লাইফ অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। সাত বছর ধরে কেন মেশিনগুলো পাল্টানো হলো না, এখানে একাধিক দফতরের ব্যর্থতা, মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয়হীনতা আছে। এই মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রী পারেন এখানে একটু আলো জ্বালতেত। কারণ এই মেশিনগুলো কেনা অনেক দীর্ঘ প্রক্রিয়া। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি বিশেষ কমিটি তৈরি করে ফাস্টট্র্যাক উদ্যোগ নিয়ে ছয়টি মেশিন একসঙ্গে কেনা উচিত।