দেশে দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব, অনিশ্চিত গন্তব্যে শিল্প খাত

দেশে দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব, অনিশ্চিত গন্তব্যে শিল্প খাত
করোনা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং দেশে বিদ্যমান সংকটে বহুমুখী নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে শিল্প খাতে। দেশে ডলার ও আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দাম বাড়ায় আমদানি খরচ বেড়েছে। ডলার সংকট ভয়াবহ রূপ নেওয়ায় এলসি খোলা যাচ্ছে না। এতে শিল্পের যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানি কমেছে। এ কারণে অনেক শিল্প এখন বন্ধের পথে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দায় ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতা কমায় রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
রপ্তানি আয় দেশে আসার হার কমেছে। জ্বালানি তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম দফায় দফায় বাড়ানোর কারণে শিল্পের খরচ বেড়ে গেছে। এদিকে দেশে বিদ্যমান মন্দা ও পণ্যমূল্য বাড়ায় ভোক্তার ভোগের মাত্রা কমে গেছে। এর প্রভাবে শিল্পপণ্যের বিক্রি কমে গেছে। ফলে উদ্যোক্তাদের হাতে নগদ অর্থের জোগানেও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। সব মিলে শিল্প খাত বড় এক অনিশ্চিত গন্তব্যের মুখোমুখী হয়েছে। শিগগিরই যে এ সংকটের সমাধান হবে, এর কোনো আভাস মিলছে না।সূত্র জানায়, ২০২০ সালের আগে থেকেই অর্থনীতির নানা খাতে সমস্যা বিদ্যমান ছিল। ২০২০ সালের মার্চে করোনার সংক্রমণ এবং ২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে তিন বছর ধরে বৈশ্বিক ও দেশে অর্থনৈতিক সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। এর প্রভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে শিল্পের যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল থেকে শুরু করে সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়েছে। এতে বেড়ে যায় আমদানি ব্যয়। আর ডলারের দাম বেড়ে যায় প্রায় ২৬ শতাংশ। সেখানেও আমদানি ব্যয় বাড়ে। বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয়ের তুলনায় আয় কমায় ডলার সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে শিল্পের যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানি ব্যাপকভাবে কমে গেছে। ফলে অনেক শিল্প এখন কাঁচামালের অভাবে বন্ধের পথে। ডলার সংকট খুব শিগগির মিটবে বলে তেমন কোনো ইঙ্গিত নেই। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধও থামার কোনো লক্ষণ নেই। ফলে দ্রুত বৈশ্বিক সংকট কাটছে না।
ডলার সংকট: শিল্প খাতে এখন ডলার সংকটের ভয়াবহ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। ২০২১ সালের আগস্ট থেকে ডলার সংকট শুরু হয়। গত বছরের মে মাসে তা প্রকট আকার ধারণ করে। জুলাই থেকে পণ্য আমদানিতে ব্যাপক কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। গত সেপ্টেম্বর থেকে ডলারের সংস্থান ছাড়া এলসি খোলা বন্ধ করে দেওয়া হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকও শুধু অতিজরুরি পণ্য ছাড়া অন্য খাতের পণ্য আমদানিতে রিজার্ভ থেকে ডলারের জোগান বন্ধ করে দেয়। এতে শুধু রপ্তানি খাত ও রেমিট্যান্সের অর্থে কিছু জরুরি পণ্যের এলসি খোলা হয়। বাকি সব খাতে এলসি খোলা বন্ধ রাখা হয়। এর মধ্যে শিল্পের বড় একটি অংশ রয়েছে। শিল্প খাতের মোট ঋণের মাত্র ২০ শতাংশ রপ্তানি খাতে। বাকি ৮০ শতাংশ অন্যান্য খাতে। ওই ৮০ শতাংশ খাতই ডলার সংকটের প্রভাবে এখন ভোগছে। কারণ, তারা রপ্তানি করে না বলে ডলারের সংস্থান করতে পারে না। এর মধ্যে ভোগ্যপণ্যসহ জ্বালানি ও ওষুধশিল্পও রয়েছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি সময়ে আমদানির এলসি খোলা কমেছে ২৫ শতাংশ। আমদানি বেড়েছে ৩ শতাংশ। এর আগে এলসি খোলা গড়ে ২০ শতাংশ এবং আমদানি ১৫ থেকে ২০ শতাংশ বেড়েছে। এর মধ্যে রপ্তানিমুখী শিল্পের কাঁচামাল আমদানির এলসি খোলা কমেছে ৩৫ দশমিক ২৩ শতাংশ, আমদানি কমেছে ৫ দশমিক ১৩ শতাংশ। এর প্রভাবে আগামী দিনে রপ্তানি আয় আরও কমে যেতে পারে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, রপ্তানি শিল্পের কাঁচামাল আমদানির জন্য জানুয়ারিতে ১০২ কোটি ডলারের এলসি খোলা হয়। ফেব্রুয়ারি ও মার্চে তা আরও কমে যাবে। ফেব্রুয়ারিতে ৯০ কোটি ডলার এবং মার্চে ৭১ কোটি ডলার হতে পারে। রপ্তানি শিল্পের কাঁচামাল আমদানির জন্য ‘ব্যাক টু ব্যাক’ এলসির দেনা জানুয়ারি-মার্চ সময়ে ২৬৩ কোটি ডলার হতে পারে। এর মধ্যে ৪৭ শতাংশ বৈদেশিক মুদ্রা রয়েছে নস্ট্রো অ্যাকাউন্ট, অফসোর ব্যাংকিং ইউনিট ও ফরেন কারেন্সি ক্লিয়ারিং অ্যাকাউন্টে। বাকি ৫৩ শতাংশ অর্থের সংস্থান করতে হবে নিজস্ব উদ্যোগে। ফলে ডলারের সংকট থাকছেই। আগে রপ্তানির অর্থে কাঁচামাল আমদানি করেও কিছু বাড়তি থাকত।
এখন আর সেটি থাকে না, উলটো রপ্তানিকারকদেরও বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ নিতে হচ্ছে। ফলে শিল্পের ও বাণিজ্যিক আমদানিতে এখন ভরসা কেবলই রেমিট্যান্স। এ খাতেও চলছে মন্দা। গত অর্থবছরে রেমিট্যান্স কমেছিল ১৫ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে সেই কমার ওপর মাত্র ৪ শতাংশ বাড়তে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। একই সঙ্গে সার্বিকভাবে আমদানির এলসি খোলাও ফেব্রুয়ারি-মার্চে কমে গড়ে ৪২১ কোটি ডলারে নামতে পারে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, মন্দার প্রভাব এখন বেশি মাত্রায় পড়তে শুরু করেছে। রপ্তানি আয় ও নতুন অর্ডার আসার প্রবণতা কমছে। গ্যাস, বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ফলে খরচ বেড়েছে। এখন টিকে থাকাই কঠিন হয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, রপ্তানি ছাড়াও শিল্পের অন্যান্য খাতেও কাঁচামালের সংকট চলছে। অনেক প্রতিষ্ঠান মধ্যবর্তী কাঁচামাল আমদানি করে পূর্ণাঙ্গ পণ্য তৈরি করে। এসব কাঁচামালের এলসি কমেছে ৩৩.৩০ শতাংশ, আমদানি কমেছে ১৮.৫৬ শতাংশ। এর মধ্যে রড, ইস্পাতের মতো ভারী শিল্পের কাঁচামালের আমদানি কমেছে ৭০ শতাংশ, এলসি খোলা কমেছে ৬০ শতাংশ। ফলে এসব শিল্প এখন কাঁচামাল সংকটে ভুগছে। ওষুধশিল্পের কাঁচামাল আমদানি কমেছে ১২ শতাংশ, এলসি কমেছে ২২ শতাংশ।  উৎপাদন কমেছে : বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, গত অর্থবছরের সেপ্টেম্বরে শিল্প উৎপাদনের সূচক বেড়েছিল ৫০৬ পয়েন্ট। চলতি অর্থবছরের সেপ্টেম্বরে তা বেড়েছে ৪৯৬ পয়েন্ট। ওই সময়ে শিল্পের প্রধান ১১টি খাতের মধ্যে ছয়টি খাতে উৎপাদন কমেছে। কম গুরুত্বপূর্ণ এমন ৫টি খাতে উৎপাদন বেড়েছে। এর মধ্যে পোশাক খাতে ২.২১, বস্ত্র খাতে ৩.৬০, খাদ্যে ৮.২৫, অধাতু খনিজ পণ্যে ২.০৮, রাসায়নিক পণ্যে ৫০ এবং মেটাল পণ্য ১৬ শতাংশ কমেছে।
এছাড়া ওষুধে ১.৩৭, লেদারে ২৬, বেসিক মেটাল ২০.৫, টোব্যাকোতে ০.৬৯ এবং অন্যান্য শিল্পে ৫.২৯ শতাংশ বেড়েছে। ছোট শিল্পে গত অর্থবছরের এপ্রিল-জুনের তুলনায় চলতি অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে উৎপাদন কমেছে ১০.৩২ শতাংশ। তবে চলতি অর্থবছরের সাত মাসের গড় হিসাবে উৎপাদন বেড়েছে ৭.৪২ শতাংশ।
শিল্পের খরচ বেড়েছে, ভোক্তার আয় কমেছে : ডলার, কাঁচামাল এবং গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ার কারণে উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে। এর প্রভাবে বেড়েছে পণ্যের দাম। গত বছরের জুন থেকে গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত গ্যাসের দাম দুই দফায় ১০০ থেকে ৩০০ শতাংশ, বিদ্যুতের দাম তিন দফায় ১৫ শতাংশ, জ্বালানি তেলের দাম এক দফায় ৪২ থেকে ৫২ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। এর সঙ্গে সবকিছুর দাম বেড়েছে। ফলে শিল্পের উৎপাদন খরচ বাড়ায় পণ্যের দামও বেড়েছে ১৫ থেকে ৫০ শতাংশ।
এদিকে অর্থনৈতিক মন্দায় ভোক্তার আয় কমেছে, বেড়েছে ব্যয়। বিবিএস-এর হিসাবে ব্যয় বেড়েছে সাড়ে ৮ শতাংশ। আয় বেড়েছে ৭ শতাংশ। ব্যয়ের তুলনায় আয় কম হচ্ছে দেড় শতাংশ। ফলে বাধ্য হয়ে ভোক্তারা চাহিদায় কাটছাঁট করেছে। এর প্রভাব পড়েছে খাদ্য, শিল্প ও বিলাসী পণ্যের কেনাবেচায়। এতে উদ্যোক্তারা উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করতে পারছেন না। এ প্রসঙ্গে জাতীয় ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প সমিতির সূত্র জানায়, ছোট শিল্পগুলো এখন বেশি ধুঁকছে। পণ্যের বেচাকেনা কমে গেছে। ফলে তারা উৎপাদনও কমিয়ে দিয়েছেন। শ্রমিক ছাঁটাইও হয়েছে এ খাতে বেশি। মন্দার প্রভাব নিয়ে একটি জরিপ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এটি হলে প্রকৃত অবস্থা বোঝা যাবে।
ঋণ বিতরণ কমেছে : টাকার হিসাবে শিল্প খাতে মেয়াদি ও চলতি মূলধন ঋণ বিতরণ বেড়েছে। কিন্তু ডলারের হিসাবে কমেছে। শিল্প খাতে ঋণের একটি বড় অংশই ব্যয় হয় যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানি করতে। এগুলোয় ডলারের প্রয়োজন হয়। ফলে ডলারের হিসাবে ঋণ কমায় প্রকৃতপক্ষেই এ খাতে ঋণ বিতরণ কমেছে। বিশেষ আমদানি ও রপ্তানি খাতে ঋণ বিতরণ টাকার হিসাবে ১৯ শতাংশ বাড়লেও ডলারের হিসাবে সাড়ে ৬ শতাংশ কমেছে। কারণ, গত এক বছরের ডলারের বিপরীতে টাকার প্রায় ২৬ শতাংশ অবমূল্যায়ন হয়েছে। ফলে ডলারের দাম বেড়েছে, কমেছে টাকার মান।
শিল্প খাতে মেয়াদি ঋণ গত অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে বিতরণ করা হয়েছিল ৪২ হাজার কোটি টাকা, চলতি অর্থবছরের একই সময়ে করা হয়েছে ৫২ হাজার কোটি টাকা। আলোচ্য সময়ে ঋণ বেড়েছে ২৩ শতাংশ। এর বড় অংশই হচ্ছে আগের ঋণ পরিশোধ না করার কারণে সুদসহ সার্বিক ঋণের প্রবৃদ্ধি। করোনা ও বৈশ্বিক মন্দার কারণে গত তিন বছর এ খাতে ঋণ পরিশোধে বড় ছাড় দেওয়া হয়। ফলে নতুন ঋণ বিতরণ হয়েছে খুবই কম।
এদিকে চলতি মূলধন ঋণ কমেছে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। এদিকে শিল্প খাতে বকেয়া ঋণের স্থিতি বেড়েই চলেছে। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে বকেয়া ছিল ৪৭ হাজার কোটি টাকা, গত সেপ্টেম্বরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৪ হাজার কোটি টাকায়। ঋণ পরিশোধ করতে না পারায় এ খাতে বকেয়ার স্থিতি বেড়ে যাচ্ছে, যা শিল্প খাতে খেলাপি ঋণ বাড়িয়ে দিচ্ছে।
গত অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বরে গ্রামের অপ্রাতিষ্ঠানিক ক্ষুদ্র শিল্পে ঋণপ্রবাহ বেড়েছিল ৪৫ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে কমেছে ৬.৬১ শতাংশ। গত অর্থবছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত এ খাতে বকেয়া ঋণ ছিল ৬ হাজার ৯৩২ কোটি টাকা। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ২১২ কোটি টাকা। অর্থের প্রবাহ এবং ডলারের দাম বাড়ায় শিল্পের যন্ত্রপাতি এলসি কমেছে ৬৬ দশমিক ৮৩ শতাংশ, আমদানি কমেছে সাড়ে ৭ শতাংশ। বিবিধ শিল্পের যন্ত্রপাতি এলসি কমেছে ৪৪ দশমিক ৪৫ শতাংশ, আমদানি কমেছে ২৩ শতাংশ। ফলে নতুন শিল্প স্থাপনের গতিও কমে গেছে।
গত অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বরে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) এসেছিল ১১২ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে এসেছে ১১৫ কোটি ডলার। বিনিয়োগ সামান্য বাড়লেও এর বেশির ভাগই দেশে অর্জিত কোম্পানিগুলোর মুনাফা থেকে করা। ফলে নতুন বিনিয়োগ এসেছে খুবই কম। সরকার করোনার পর বেশ জাঁকজমকপূর্ণভাবে নতুন ব্যবসা করতে ছোট উদ্যোক্তাদের ঋণ দিতে চালু করেছিল স্টার্ট আপ ফান্ড। এ খাতে গত এক বছরে বিনিয়োগ কমেছে ৭৪ শতাংশ। ২০২১ সালে এ খাতে বিনিয়োগ এসেছিল ৪১ কোটি ৫০ লাখ ডলার। গত বছর তা কমে দাঁড়িয়েছে ১০ কোটি ৯০ লাখ ডলারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *