রুয়েটে ল্যাবের যন্ত্রপাতি কেনাকাটার প্রক্রিয়া একদিনেই শেষ, ইউজিসির তদন্ত প্রতিবেদন দুদকে

রুয়েটে ল্যাবের যন্ত্রপাতি কেনাকাটার প্রক্রিয়া একদিনেই শেষ, ইউজিসির তদন্ত প্রতিবেদন দুদকে

রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) গ্লাস অ্যান্ড সিরামিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ল্যাব স্থাপনে যন্ত্রপাতি কেনাকাটায় অবিশ্বাস্য কাণ্ড ঘটিয়েছেন প্রকল্প পরিচালক অধ্যাপক ড. আব্দুল আলীম। সব আইন ও নীতিমালা উপেক্ষা করে একরকম অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন তিনি। প্রকল্প মেয়াদের শেষদিনেই কেনাকাটা ও মালামাল বুঝিয়ে নেওয়াসহ সব প্রক্রিয়া শেষ করার মতো অবিশ্বাস্য কাজটি করেছেন ড. আলীম।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে ‘পাঁচটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন বিভাগ চালুর লক্ষ্যে অবকাঠামোগত ও ল্যাবরেটরি সুবিধা’ শীর্ষক আমব্রেলা প্রকল্পের আওতায় রুয়েটে গ্লাস অ্যান্ড সিরামিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ চালুর বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এজন্য ব্যয় ধরা হয় ২৬ কোটি ১১ লাখ টাকা। কাজ শুরু হয় ২০০৯ সালের ১ জুলাই। কাজ শেষ করার জন্য ২০১৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত সময় বেঁধে দেওয়া হয়।

পরে অবশ্য পরিকল্পনা কমিশনে আবেদন করে মেয়াদ দুই বছর বাড়িয়ে ২০১৬ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত করা হয়। প্রকল্পের সার্বিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য রূপালী ব্যাংক রুয়েট শাখায় একটি হিসাব (নং-২০০০০৪৩৮৫, জিসিই বিভাগ) খোলা হয়। এই প্রকল্পের সবশেষ পিডি ছিলেন রুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. আব্দুল আলীম।

নথি পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৬ সালের ৩০ জুন ছিল ওই প্রকল্পের মেয়াদের শেষদিন। ২৬ কোটি ১১ লাখ টাকার প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন হয়েছে বলে ওই বছরেরই ৯ আগস্ট ইউজিসির কাছে পিসিআর প্রদান করেন প্রকল্পের পরিচালক ড. আলীম। ওই রিপোর্টে তিনি প্রকল্পটি সম্পন্নরূপে সমাপ্ত ও অ্যাকাউন্টে টাকা শূন্য দেখান।

কিন্তু ওই প্রকল্পের ব্যাংক অ্যাকাউন্টের স্ট্যাটমেন্ট যুগান্তরের হাতে এসেছে। তাতে দেখা যায়, প্রকল্প সমাপ্তের রিপোর্ট দেওয়ার পরও প্রকল্পের অ্যাকাউন্টে ১৩ কোটি ১৫ লাখ ৭ হাজার ২৭২ টাকা জমা ছিল। তবে প্রকল্প সমাপ্তির চার বছর পরও ২০২০ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বিভিন্ন কাজের বিল দেখিয়ে ১২ কোটি ৬৪ লাখ ৭০ হাজার ৪১৩ টাকা তোলা হয়েছে ওই অ্যাকাউন্ট থেকে। টাকা তোলার পর এখনো অ্যাকাউন্টে পড়ে আছে ৫০ লাখ ৩৬ হাজার ৮৫৯ টাকা।

সরকারি বিধি মোতাবেক যে কোনো কাজের বিল প্রদানের সময় ক্ষেত্রবিশেষে ১২ থেকে ১৪ শতাংশ টাকা ভ্যাট-ট্যাক্স বাবদ কেটে নেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে তা ভ্যাট ও ট্যাক্স অফিসে জমা দেওয়া হয়। কিন্তু ২০১৬ সালের ৩০ জুন থেকে ২০২০ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত উত্তোলন করা বিলের ভ্যাট-ট্যাক্সের প্রায় দেড় কোটি টাকা জমা দেওয়ার তথ্য পাওয়া যায়নি।

এদিকে প্রকল্প শেষ হওয়ার পরও টাকা উত্তোলনের ক্ষেত্রে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং ইউজিসি থেকে অনুমোদন দেওয়া হয়নি। পরে ড. আলীমের ‘জাদুকরী ক্যারিশমা’র বিষয়টি জানাজানি হলে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) তদন্ত কমিটি করে। ইউজিসির তদন্তে ধরা পড়ে, প্রকল্প শেষ হওয়ার রিপোর্ট দেওয়ার পরও প্রকল্পের অ্যাকাউন্টে ১৩ কোটি ১৫ লাখ ৭ হাজার ২৭২ টাকা জমা ছিল। এরপর চার বছর ধরে বিভিন্ন কাজের বিল দেখিয়ে বিভিন্ন চেকের মাধ্যমে টাকা তোলা হয়েছে। এখনো ৫০ লাখ ৩৬ হাজার ৮৫৯ টাকা আছে ওই অ্যাকাউন্টে। কিন্তু তা ফেরত দিতে কোনো উদ্যোগ নেননি প্রকল্প পরিচালক ড. আলীম। তদন্তে ড. আলীমের বিরুদ্ধে এই প্রকল্পে নানা অনিয়মের সত্যতা মিলেছে বলেও জানিয়েছেন ইউজিসির সচিব ড. ফেরদৌস জামান।

সোমবার ইউজিসির সচিব ড. ফেরদৌস জামান বলেন, ‘দুদকের নির্দেশে অভিযোগ তদন্ত করেছিল ইউজিসি। তদন্ত প্রতিবেদন দুদকেই জমা দেওয়া হয়েছে। তারাই পরবর্তী করণীয় ঠিক করবে।’

একই প্রকল্পের আওতাধীন গ্লাস অ্যান্ড সিরামিক ইঞ্জিনিয়ারিং (জিইসি) বিভাগের ল্যাবরেটরির জন্য বিদেশি মেশিনারিজ ও ইকুইপমেন্ট ক্রয়ে ২০১৬ সালের ৩০ জুন ঢাকার ‘এনটেক লজিস্টিকস লিমিটেড’ নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে চুক্তি করতে চিঠি দেন প্রকল্প পরিচালক ড. আব্দুল আলিম। ই-টেন্ডার আইডি নং ৫৯৭৬০। ওই চিঠিতে কার্যাদেশ প্রদানের জন্য ২০১৬ সালের ১৪ জুলাইয়ের মধ্যে পারফরম্যান্স সিকিউরিটি হিসাবে ৬ লাখ ৭৮ হাজার ২০০ টাকা জমা দিয়ে চুক্তি সম্পাদন করতে বলা হয়।

কাজটির চুক্তিমূল্য ছিল ৬৭ লাখ ৮২ হাজার টাকা। কিন্তু নথিপত্রে দেখা যায়, প্রকল্প পরিচালক কেনাকাটা থেকে মালামাল বুঝিয়ে পাওয়ার সব প্রক্রিয়া মেয়াদের শেষদিনেই কাগজেকলমে সম্পন্ন করেছেন। শুধু তাই নয়, ওই একই দিনেই সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে ওই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে ইস্যু ভাউচার প্রদান করা হয়। একই তারিখে কাজটির বিল প্রস্তুত ও অডিট সম্পন্ন করে চেক প্রদানও করেন প্রকল্প পরিচালক অধ্যাপক ড. আলীম। কিন্তু বাস্তবে ওইদিন কোনো মেশিনারিজ ও ইকুইপমেন্ট সরবরাহ করা হয়নি। কিন্তু কাগজেকলমে কেনাকাটা সম্পন্ন দেখানো হয়েছে।

এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক অধ্যাপক ড. আব্দুল আলীম বলেন, এই প্রকল্পের সাব-প্রকল্পের শেষ কিস্তির টাকা আসে প্রকল্প মেয়াদের শেষদিন ৩০ জুনে। সময় স্বল্পতার কারণে একই দিনে কেনাকাটা দেখানো হয়েছে। তবে পরে ঠিকাদার মালামাল সরবরাহ করেছে। আর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তাদের বিল এখনো দাখিল না করায় অ্যাকাউন্টে টাকা পড়ে আছে।’

রুয়েটের তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ড. রফিকুল আলম বেগ জানিয়েছেন, উপাচার্যের কাজ শুধু স্বাক্ষর করা। তখন কী হয়েছে, তা আর মেমোরিতে নেই। প্রকল্পসংশ্লিষ্টরাই ভালো জানেন।