বিশ্বের বহুল আলোচিত জাহাজ দুর্ঘটনায় টাইটানিক নামের যে বিলাসবহুল জাহাজটি সমুদ্রে ডুবে গিয়েছিল, প্রথমবারের মতো সেই জাহাজের পূর্ণাঙ্গ একটি ছবি পাওয়া গেছে। ছবিটি আটলান্টিকের ১২ হাজার ৫০০ ফুট নিচে ডুবে থাকা জাহাজটির ধ্বংসাবশেষের প্রথম ডিজিটাল স্ক্যান। যা গভীর সমুদ্র ম্যাপিং পদ্ধতি ব্যবহারের মাধ্যমে তৈরি করা হয়েছে।
এতে টাইটানিকের থ্রিডি অর্থাৎ দৈর্ঘ্য, প্রস্থ এবং উচ্চতা, এ তিন মাত্রার দৃশ্য পাওয়া যাচ্ছে। যা এর আগে কখনো দেখা যায়নি। ছবিগুলো দেখার পর মনে হবে, আটলান্টিক সাগর থেকে সব পানি সরিয়ে এরপর সমুদ্রের তলদেশে পরিত্যক্ত বিশাল আকারের জাহাজটির ফটোশ্যুট করা হয়েছে।

১৯১২ সালে সমুদ্রে ডুবে যাওয়া এ জাহাজে মূলত কী ঘটেছিল, এসব দৃশ্য থেকে সে সম্পর্কে নতুন কিছু জানা যাবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে। এটি উদ্বোধনী যাত্রায় সমুদ্রে ভাসমান বিশালাকৃতির বরফের (আইসবার্গ) সঙ্গে ধাক্কা লাগার পর ডুবে গিয়েছিল। এতে দেড় হাজারেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। যুক্তরাজ্যের সাউদাম্পটন থেকে জাহাজটি যাত্রা শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে যাচ্ছিল।
টাইটানিক জাহাজের ব্যাপারে এখনো অনেক প্রশ্ন রয়েছে মানুষের মনে। সেসব প্রশ্নের উত্তর জানা প্রয়োজন বলে মনে করেন টাইটানিক বিশেষজ্ঞ পার্কস স্টিফেনসন। তিনি বলেন, কোনো জল্পনা-কল্পনার ওপর ভিত্তি করে গবেষণা নয়, বরং তথ্যপ্রমাণ-ভিত্তিক গবেষণাকে অগ্রসরের জন্য এই ধরনের মডেল প্রথম কোনো পদক্ষেপ।

বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন বলছে, ১৯৮৫ সালে প্রথমবারের মতো সমুদ্রের তলদেশে জাহাজটির খোঁজ পাওয়া যায়। এরপর থেকে ব্যাপক গবেষণা শুরু হয় জাহাজটি নিয়ে। কিন্তু জাহাজটি এত বড় এবং সমুদ্রের গভীরে অন্ধকার হওয়ায় ক্যামেরা দিয়ে এতদিন যেসব ছবি তোলা হয়েছে তা জাহাজের কিছু অংশের। কখনোই ডুবে যাওয়া পুরো জাহাজের ছবি পাওয়া যায়নি। তবে এখন নতুন অনুসন্ধানে পুরো টাইটানিকের ছবি পাওয়া গেল।
ছবিতে দেখা যাচ্ছে সমুদ্রের তলদেশে দুটো অংশে ভাগ হয়ে পড়ে আছে টাইটানিক জাহাজ। জাহাজের অগ্রভাগ, যেখান থেকে বাঁকা হতে থাকে সেই অংশ এবং জাহাজের পশ্চাদভাগ। এই দুটো অংশের মাঝের দূরত্ব ২৬০০ ফুট (৮০০ মিটার)। ভেঙে যাওয়া এই জাহাজের আশপাশে প্রচুর ধ্বংসাবশেষ পড়ে রয়েছে।

ম্যাগেলান লিমিটেড নামের একটি ডিপ-সি ম্যাপিং কোম্পানি এবং আটলান্টিক প্রোডাকশন্স নামের একটি প্রতিষ্ঠান ২০২২ সালের গ্রীষ্মকালে টাইটানিক জাহাজের এ বিষয়ে একটি তথ্যচিত্র তৈরি করছে এবং এসব ছবি তারা যৌথভাবে তুলেছে।
একদল কর্মী নিমজ্জনযোগ্য বিশেষ একটি জাহাজের মাধ্যমে এ জরিপ পরিচালনা করেছে। যা রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করাা যায়। দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ মিলিয়ে পুরো টাইটানিক জাহাজের ছবি তুলতে তাদের সময় ব্যয় হয়েছে ২০০ ঘণ্টারও বেশি। জাহাজটির প্রতিটি কোণ থেকে সাত লাখেরও বেশি ছবি তুলেছে যারা। যেগুলোর সাহায্যে পুরো টাইটানিকের একটি থ্রিডি ছবি তৈরি করেছে তারা।

এই অভিযানের পরিকল্পনায় নেতৃত্ব দিয়েছেন ম্যাগেলান লিমিটেডের গেরহার্ড সেফার্ট। তিনি বলছেন, এখনো পর্যন্ত পানির নিচে ছবি তোলার যত প্রকল্প পরিচালনা করেছেন, তার মধ্যে এটিই সবচেয়ে বড়। প্রায় ৪০০০ মিটার গভীরতা। তাদের সামনে বিশাল চ্যালেঞ্জ ছিল। একই সঙ্গে সেখানে পানির স্রোতও রয়েছে। এছাড়া তাদের কোনো কিছু স্পর্শ করার অনুমতি ছিল না। কারণ, এতে জাহাজের ধ্বংসাবশেষের ক্ষতির সম্ভাবনা যেন তৈরি না হয়।
তিনি বলেন, আরেকটি চ্যালেঞ্জ হচ্ছে প্রতিটি বর্গ সেন্টিমিটারের ম্যাপিং করা। এমনকি জাহাজের যেসব অংশ আগ্রহ-উদ্দীপক নয় সেসবেরও। যেমন, যেখানে ধ্বংসাবশেষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে সেখানকার মাটির ছবি। কেননা, জাহাজের বিভিন্ন অংশকে একত্র করার জন্য সেসব ছবিও প্রয়োজন।

ছবিতে টাইটানিকের যা দেখা যাচ্ছে :
ছবিগুলোয় টাইটানিকের বিশালত্বের পাশাপাশি জাহাজটির একটি প্রপেলারের সিরিয়াল নম্বরের মতো ছোটখাটো বিষয়ও ধরা পড়েছে। জাহাজটির সম্মুখভাগ মরিচা ধরে ঢাকা পড়ে আছে। এরপরও শতাধিক বছর আগে ডুবে যাওয়া জাহাজটি চেনা যায়। এর উপরে রয়েছে জাহাজের ডেক, যেখানে একটি গর্ত রয়েছে। সেখান থেকে একটি শূন্যতা দেখতে পাওয়া যায়। যেখানে একসময় জাহাজের অনেক বড় সিঁড়ি ছিল।
জাহাজের পশ্চাদভাগে বিভিন্ন ধাতব পদার্থের জঞ্জাল রয়েছে। এই অংশটি সমুদ্রের তলদেশে পড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ধসে পড়ে। জাহাজটির আশপাশে বিভিন্ন জিনিস ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। এসবের মধ্যে রয়েছে জাহাজ থেকে খসে পড়া অলঙ্কৃত ধাতব বস্তু, মূর্তি এবং মুখ খোলা হয়নি এ রকম শ্যাম্পেনের বোতল। আবার অনেক ব্যক্তিগত জিনিসপত্রও রয়েছে। ছবিতে দেখা যায় সমুদ্রের তলানির ওপর অসংখ্য জুতা পড়ে আছে।

টাইটানিকের ওপর দীর্ঘদিন গবেষণা করা পার্কস স্টিফেনসন বলছেন, এসব ছবি প্রথমবার দেখে বিস্মিত হয়েছিলেন তিনি। বলেন, আপনি জাহাজের এমন ধ্বংসাবশেষ দেখতে পাচ্ছেন যা কখনো দেখা সম্ভব হয়নি। আপনি ডুবন্ত পুরো জাহাজটিকে দেখতে পাচ্ছেন। আশপাশের পরিবেশসহ বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে আপনি এটাকে দেখতে পাচ্ছেন। আপনি যা দেখতে পাচ্ছেন এটাই এখন এই জাহাজের সত্যিকারের অবস্থা।

তিনি আরও বলেন, এসব ছবি পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখলে ১৯১২ সালের ওই ভয়াবহ রাত্রিতে টাইটানিকের ক্ষেত্রে আসলেই কী ঘটেছিল, সেবিষয়ে নতুন কিছু ধারণা পাওয়া যেতে পারে। আইসবার্গের সঙ্গে কেমন করে সংঘর্ষ হয়েছিল সেবিষয়ে আসলেই আমাদের ধারণা নেই। আমরা এও জানি না, সিনেমাতে যেমন দেখানো হয়েছে সেরকম করে জাহাজের সামনের একপাশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়েছিল কি না। জাহাজের পেছনের অংশ গবেষণা করলে টাইটানিক কিভাবে সমুদ্রের তলদেশে আঘাত হেনেছিল সেবিষয়েও ধারণা পাওয়া যেতে পারে।

সমুদ্রের পানিতে ডুবে যাওয়া জাহাজের ক্ষয় অব্যাহত রয়েছে। পানিতে থাকা অণুজীব বা জীবাণু ক্রমশই এটিকে খেয়ে ফেলছে। এছাড়াও এর বিভিন্ন অংশ ক্রমশই আলাদা হয়ে খসে পড়ছে।
সমুদ্রে এরকম একটি দুর্ঘটনার কারণ বুঝতে সময় যে ক্রমশ ফুরিয়ে আসছে ইতিহাসবিদরা এবিষয়েও সচেতন। কিন্তু এখন যেসব ছবি পাওয়া গেল, সেখান থেকে জাহাজের খুঁটিনাটি বিষয়ও বিশেষজ্ঞরা পরীক্ষা করে দেখতে পারবেন। আশা করা হচ্ছে যে, এখন হয়তো টাইটানিকের আরও অনেক গোপন বিষয় বের হয়ে আসবে।