পাবিপ্রবি ৩ শিক্ষার্থীকে রাতভর নির্যাতনের অভিযোগ ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে

পাবিপ্রবি ৩ শিক্ষার্থীকে রাতভর নির্যাতনের অভিযোগ ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে

ছাত্রশিবির সন্দেহে পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (পাবিপ্রবি) তিন সাধারণ শিক্ষার্থীকে রাতভর নির্যাতন করার অভিযোগ উঠেছে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। রাত ১১টা থেকে রাত ৩টা পর্যন্ত একটানা নির্যাতনের পর তাদের পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছে ছাত্রলীগ ও পাবিপ্রবি কর্তৃপক্ষ। তাদের উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করেছে পুলিশ। মঙ্গলবার দিবাগত রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আবাসিক হলে এ ঘটনা ঘটে।

নির্যাতিত শিক্ষার্থীরা হলেন- লোক প্রশাসন বিভাগের মাস্টার্স শেষ বর্ষের ছাত্র গোলাম রহমান জয়, ইংরেজি বিভাগের চতুর্থ বর্ষের আসাদুল ইসলাম এবং ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই) বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আবদুল আজিজ। ওই তিন শিক্ষার্থীর মধ্যে গোলাম রহমানের অবস্থা গুরুতর। তিনি বর্তমানে পাবনা জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। অন্য দুইজনকে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে পাবনা সদর থানায় পুলিশ হেফাজতে রাখা হয়েছে।

এদিকে তিন শিক্ষার্থীকে নির্যাতনের দায়ভার নিচ্ছে না বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, শাখা ছাত্রলীগ ও পুলিশ। ছাত্রলীগ ও পাবিপ্রবি কর্তৃপক্ষের দাবি- তাদের কোনো প্রকার নির্যাতন করা হয়নি। সম্পূর্ণ সুস্থ অবস্থায় পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হয়েছে। সেই সময় তাদের শরীরে আঘাতের কোনো চিহ্ন ছিল না। আর পুলিশের দাবি- শিক্ষার্থীদের আহতাবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে। তবে নির্যাতিত শিক্ষার্থীরা সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করে বলেন, তারাবিহর নামাজের পর থেকে রাত ৩টা পর্যন্ত তাদের নির্মমভাবে নির্যাতন করেন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা।

নির্যাতিত শিক্ষার্থী ও তাদের বন্ধুরা জানিয়েছেন, তারাবিহর নামাজের পর ভুক্তভোগী তিন শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারে আড্ডা দিচ্ছিলেন। এ সময় ছাত্রলীগ কর্মী আপেল, শেহজাদ, তোফিকসহ ১০-১২ জন তাদের কাছে এসে শিবির কিনা জানতে চান। পরে ওদের জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা শহিদ মিনার থেকে হলে নিয়ে যান।

এ সময় পাবিপ্রবি ছাত্রলীগের সভাপতি ফরিদুল ইসলাম বাবুর নেতৃত্বে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তাদের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের তিনটি রুমে নিয়ে স্ট্যাম্প, রড, হকিস্টিকসহ দেশীয় অস্ত্র দিয়ে নির্যাতন করা হয়। হাতুড়ি, জিআই পাইপ, তালা দিয়েও মারধর করা হয় তাদের। নির্যাতনের একপর্যায়ে ছাত্রশিবিরের সঙ্গে সম্পৃক্ততার বিষয়ে স্বীকারোক্তি নিয়ে তাদের পুলিশের হাতে সোপর্দ করা হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সভাপতি ফরিদুল ইসলাম বাবু জানান, তিনি রাত ১২টার দিকে খবর পান কয়েক শিবির কর্মী বিশ্ববিদ্যালয় মাঠে গোপন বৈঠক করছিলেন। সাধারণ ছাত্ররা তাদের আটক করে রাখেন। তারা হলের আবাসিক ছাত্র নন এবং ক্যাম্পাসের বাইরে থাকেন। অথচ এত রাতে তাদের বৈঠক ছিল সন্দেহজনক। এ সময় আটক তিন ছাত্র স্বীকার করেন তারা শিবির কর্মী। তাদের কাছে শিবিরের বইপত্রও পাওয়া যায়। তিনি জানান, ছাত্রলীগ কর্মীরা তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছে মাত্র। তাদের কোনো নির্যাতন করা হয়নি। একজনকে আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এ বিষয়ে তিনি জানান, তারা মারধরের সঙ্গে জড়িত নন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী জানান, এ ঘটনার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ব্যর্থতা রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ওই তিন শিক্ষার্থীকে নির্যাতন থেকে রক্ষা করতে পারতেন; কিন্তু তারা শিক্ষার্থীদের রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছেন। এর আগেও বিশ্ববিদ্যালয়ে অসংখ্য মারামারির ঘটনা ঘটেছে; কিন্তু প্রশাসন নীরব ভূমিকা পালন করেছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর কামাল হোসেন জানান, তিনি রাত সাড়ে ১২টার দিকে খবর পান যে, ক্যাম্পাসে ঝামেলা হয়েছে। তিনি তখন সহকারী প্রক্টর, ছাত্র উপদেষ্টাকে নিয়ে ক্যাম্পাসে পৌঁছান। তারা দেখতে পান, তিনজনকে হলের শতাধিক ছাত্র ঘিরে রেখেছেন। তখন উপস্থিত ছাত্ররা জানান- এ তিনজন শিবির কর্মী। তারা গোপন বৈঠক করছিলেন। তখন তিন শিক্ষার্থীকে জিজ্ঞাসা করলে তারা জানান, আমরা ১০-১২ জন বসে গল্প করছিলাম। অন্যরা চলে যেতে সক্ষম হলেও তারা তিনজন রয়ে যান। প্রক্টর জানান, তখন তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির সঙ্গে কথা বলেন এবং পুলিশে খবর দেন। পুলিশের হাতে তাদের সোপর্দ করেছি। এতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে তাৎক্ষণিক উত্তেজনা নিরসন হয়।

প্রক্টর জানান, আইন নিজের গতিতে চলবে। তারা আলাদা করে কোনো মামলা দায়ের করেননি। এদিকে বুধবার সকাল ৬টায় মেস থেকে বাসায় যাওয়ার সময় শিবির সন্দেহে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউআরপি বিভাগের ১২তম ব্যাচের ছাব্বির হোসেন শাওন নামে এক শিক্ষার্থীকে তুলে নিয়ে যাওয়ার সংবাদ পাওয়া গেছে। ওই শিক্ষার্থীর বন্ধুরা জানান, পাবনা শহর থেকে ঝিনাইদহ যাওয়ার বাস থেকে শাওনকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর থেকে শাওনকে আর পাওয়া যাচ্ছে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর, ছাত্র উপদেষ্টার সঙ্গে যোগাযোগ করলেও তারা এ বিষয়ে কিছু জানেন না বলে জানিয়েছেন।

পাবনা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কৃপা সিন্ধু বালা জানান, রাত ৩টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের ফোন পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়। পুলিশকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জানায়, শিবিরের তিন শিক্ষার্থীকে সাধারণ শিক্ষার্থীরা আটক করে রেখেছে। তিনি দেখতে পান তিন শিক্ষার্থী বেশ মারধোরের শিকার হয়েছেন। তখন তিনি তিন শিক্ষার্থীকে আলাদা করে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পারেন- হলে নিয়ে তাদের মারধর করা হয়েছে। এদের মধ্যে একজনের অবস্থা গুরুতর হওয়ায় তাকে পাবনা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অন্য দুইজন পুলিশ হেফাজতে রয়েছেন বলে জানান।

পাবনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মাসুদ আলম বলেন, তারা আহত অবস্থায় তিন শিক্ষার্থীকে উদ্ধার করেন। এখন পর্যন্ত কোনো পক্ষই থানায় বা পুলিশের কাছে কোনো লিখিত অভিযোগ দেয়নি। এদিকে এ ঘটনার পর থেকে পাবিপ্রবিতে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *